<p>ডিএনএর গঠন আবিষ্কৃত হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকান জীববিজ্ঞানী সিডনি ব্রেনার একটির খোঁজ করছিলেন।  তিনি মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক আচরণের পেছনে থাকা জীনগুলো চিহ্নিত করতে চান, আর এর জন্যই দরকার একটি সহায়ক প্রাণী। অবশেষে তিনি বেছে নিয়েছিলেন একটি খুদে নেমাটোড বা পরজীবী কৃমিজাতীয় পোকা। তার নাম সাইনোহাবডাইটিস এলিগ্যান্স, সংক্ষেপে সি এলিগ্যান। এই পোকাটির স্বচ্ছ ত্বক ও শরীরর স্বচ্ছ। তাই মাইক্রোস্কোপের নিচে জীবিত অবস্থাতেই এর দেহকোষগুলোর কাজ সরাসরি দেখা সম্ভব। এর পর থেকেই মানুষসহ অন্যান্য জীবের দেহকোষের বহু গবেষণায় সি এলিগ্যান ব্যবহৃত হয়েছে।</p> <p>ক্যালিফোর্নিয়ায় বাক ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট গর্ডন লিস্কোর মতে, খুব জটিল জীববৈজ্ঞানিক কাজের জন্য খুব সরল একটি প্রাণী বেছে নিয়েছিলেন সিডনি। খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি।</p> <p><strong>সি এলিগ্যানের সুবিধা</strong><br /> সি এলিগ্যানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর স্বচ্ছ গায়ের চামড়া। মাইক্রোস্কোপের নিচে এর দেহকোষগুলো সরাসরি দেখা যায়। এটি মাত্র এক মিলিমিটার লম্বা, ফলে ল্যাবরেটরিতে হাজার হাজার পোকা উৎপাদন করা সম্ভব। গর্ডন লিস্কোর বলেন, সি এলিগ্যানের স্বচ্ছতার কারণে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে আপনি প্রাণীটার কোষগুলো দেখতে পাচ্ছেন, জীববিজ্ঞানকে বাস্তবে ঘটতে দেখছেন।</p> <p><strong>জেনেটিক গবেষণায় সি এলিগ্যান</strong><br /> মানুষের মস্তিষ্কে শত শত বা লাখ লাখ সেল থাকে, কিন্তু সি এলিগ্যানের মধ্যে মাত্র ৩০২টি নিউরন রয়েছে, যা মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে সহজেই দেখা যায়। এই পোকাটির সরলতা জীববিজ্ঞান গবেষণার জন্য অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।  একটি  পূর্ণবয়স্ক সি এলিগ্যানের দেহকোষের সংখ্যা ১ হাজারেরও কম। এই ছোট পোকাটি পরীক্ষা করার মাধ্যমে অনেক বিরল জেনেটিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। সি এলিগ্যান্সের জিনোম সিকোয়েন্স তৈরি করার মাধ্যমে ব্রেনারের দল মানব জিনোম প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।</p> <p>১৯৮৮ সালে বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ গবেষণা করেন।  সি এলিগ্যানের একটি জিনের মিউটেশন ঘটান তাঁরা। ফলে পোকাটির জীবনকাল ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। পাঁচ বছর পরে আরেকটি জিনের মিউটেশন ঘটানো হয়। তখন সি এলিগ্যানের জীবনকাল ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। লিস্কোর মতে, ‘আমরা মনে করেছিলাম মানুষের জীবনকাল মোটামুটি নির্দিষ্ট। কিন্তু এই পোকাটিকে পরীক্ষা করে দেখা গেল প্রাণীর জীবনকাল বা আয়ু আসলে পরিবর্তন করা সম্ভব।’</p> <p>দেহকোষের আত্মহত্যার প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য সিডনি ব্রেনার, জন স্লাসটন রবার্ট হরভিজ ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান । মাতৃগর্ভে মানুষের দেহের আকৃতি গঠনের সময় দেহকোষের আত্মহত্যার প্রক্রিয়াটি ঘটে। দেহকোষের আত্মহত্যা হচ্ছে একটি জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। যে দেহকোষগুলো প্রয়োজনীয় নয়, সেগুলো আত্মহত্যা করে। আর এই গবেষণায় সি এলিগেন সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল।</p> <p>সি এলিগ্যান মহাশূন্যে পরীক্ষার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্পেস শাটল কলম্বিয়া পৃথিবীতে ফিরে আসার বিধ্বস্ত হয়। কলম্বিয়ার ভেতরে পাত্রে রাখা কিছু সি এলিগ্যান ছিল। বিধ্বস্ত হওয়ার পর সি এলিগ্যান ভর্তি পাত্রগুলোর কয়েকটি মাটিতে খুঁজে পাওয়া যায় এবং সেগুলো জীবিত ছিল।</p> <p>সি এলিগ্যানের ওপর গবেষণা চালিয়ে সিডনি ব্রেনার এবং তার সহকর্মীরা মানব দেহকোষের জীন ও বিভিন্ন রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে অমূল্য জ্ঞান অর্জন করেছেন। সি এলিগ্যান নিয়ে তাদের কাজ আমাদেরকে মানব জিনোমের সিকোয়েন্স এবং জীববিজ্ঞান সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। মোদ্দা কথা হলো  জীববিজ্ঞান গবেষণায় এই পোকার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।</p>