<p>ইংলন্ডের ইতিহাসে বীরত্বের জন্য যাঁহাদের নাম চিরস্মরণীয়, সার ফিলিপ সিডনি তাঁহাদের মধ্যে একজন। রানী এলিজাবেথ হইতে সাধারণ প্রজা পর্যন্ত সকলেই তাঁহার বীরত্বের কথা জানিত এবং তাঁহাকে সম্মান করিত। এলিজাবেথ বলিতেন, ‘সার ফিলিপ এই যুগের শ্রেষ্ঠ রত্ন।’</p> <p>সার ফিলিপ যে একজন বড় যোদ্ধা ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই; কিন্তু তিনি কেবল যোদ্ধা ছিলেন না, —একেধারে যোদ্ধা, পর্যটক, পণ্ডিত, গায়ক ও কবি ছিলেন। কিন্তু লোকে আজও যে তাঁহার নাম স্মরণ করিয়া রাখিয়াছে, সে কেবল তাঁহার সাহস, বাহুবল বা প্রতিভার জন্য নয়। নানাদিকে তাঁহার নানা কীর্তির কথা যদি সমস্তই লোপ পাইয়া যায়, তবু তাঁহার মৃত্যুকালের শেষ বীরত্বের কাহিনীই তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিবে।</p> <p>সুটফেনের যুদ্ধে আহত হইয়া সার ফিলিপের মৃত্যু হয়। যুদ্ধের আরম্ভেই তাঁহার ঘোড়া মরিয়া যায় এবং তিনি আহত হইয়া মাটিতে পড়েন। কিন্তু তাঁহার যুদ্ধের উৎসাহ তখনও মিটে নাই; তখনই আর এক ঘোড়া সংগ্রহ করিয়া তিনি আবার যুদ্ধের মাঝখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খানিকক্ষণ ভীষণ যুদ্ধের পর তাঁহার এ ঘোরাটিও যখন মারা পড়িল, তখন তিনি আবার এক ঘোড়া আনিয়া তৃতীয়বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। এবারে শত্রুপক্ষের একটু গুলি তাঁহার বুকে লাগিয়া তাঁহাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলিল এবং তাঁহার ঘোড়া পাগলের মতো ছুটিতে ছুটিতে তাঁহাকে শিবিরের কাছে আনিয়া ফেলিয়া দিল। তাঁহার দলের লোকেরা সেখানে তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া তাঁহাকে বাঁচাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিল; কিন্তু ডাক্তার বলিলেন, বাঁচিবার কোন আশা নাই।</p> <p>জ্বরে ও যন্ত্রণায় অবসন্ন হইয়া যখন তাঁহার মৃত্যুকাল উপস্থিত হইল, তখন দারুণ পিপাসা দেখা দিল, —একটু জলের জন্য তিনি অস্থির হইয়া পড়িলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে জল কি সব সময় পাওয়া যায়? বহু চেষ্টার পর অনেক কষ্টে একটি ঘটিতে করিয়া একটু জল আনিয়া তাঁহার হাতে দেওয়া হইল। তিনি মাথা তুলিয়া সেই জল পান করিতে যাইবেন, এমন সময় হঠাৎ দেখিতে পাইলেন, যে তাহারই পাশ দিয়া দুজন লোকে একটি আহত সৈনিককে লইয়া যাইতেছে; এবং সে বেচারী এমন করুণভাবে তাঁহার ঘটিটার দিকে তাকাইয়া আছে, যে মনে হয়, একটু জল পাইলে সে যেন বাঁচিয়া যায়। সার ফিলিপ তৎক্ষণাৎ ঘটিটি তাহার হাতে দিয়া বলিলেন, ‘এই নাও, আমার চাইতে তোমার দরকার বেশি।’</p> <p>ইহার কিছু পরেই তাঁহার মৃত্যু হয়। সারা জীবন নানা বীরত্বের পরিচয় দিয়া, মৃত্যুকালেও তিনি দেখাইয়া গেলেন যে তিনি কত বড় বীর।</p> <p>আর একজন বীরের কথা শোনা যায়, যিনি পিপাসার সময়ে হাতের কাছে জল পাইয়াও সে জল পান করিতে চাহেন নাই। অস্ট্রিয়ার রাজা রুডল্ফ্ একবার যুদ্ধ যাত্রা করিয়া সসৈন্যে এমন জায়গায় গিয়া পড়িলেন, যেখানে আশেপাশে কোথাও জল পাওয়া যায় না। জল আনিবার জন্য বহুদূরে লোক পাঠান হইল; তাহারা কখন ফিরিবে, পিপাসায় ব্যাকুল হইয়া সকলে তাহারই প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। বেলা যতই বাড়িয়া চলিল, জলের জন্য সকলে ততই অস্থির হইয়া পড়িতে লাগিল। কেহ কেহ বলিতে লাগিল, ‘আহা, আমাদেরই এত যন্ত্রণা, রাজা রুডল্ফ্ না জানি কত কষ্ট পাইতেছেন।’ <br /> শেষে এদিক ওদিক অনেক খুঁজিয়া এক পথিকের কাছে এক পেয়ালা জল পাওয়া গেল। সেই জল আনিয়া রাজাকে দেওয়া হইল। রুডল্ফ্ জলের পেয়ালা হাতে লইয়া বলিলেন, ‘এতগুলি তৃষ্ণার্ত লোক, এতটুকু জলে তাহাদের কি হইবে? আমার পিপাসা শুধু আমার নিজের জন্য নয়; আমার প্রত্যেক সৈন্যের পিপাসা যতক্ষণ না মিটিবে ততক্ষণ আমার তৃষ্ণা মিটিবে কিরূপে?’ এই বলিয়া তিনি পেয়ালা মাটিতে উপুড় করিয়া পৃথিবীর জল পৃথিবীকে ফিরাইয়া দিলেন।</p> <p>আর একটি এইরূপ গল্প আছে, সেও বহুদিনের কথা। প্রায় তিনশ বৎসর আগে সুইডেনের সঙ্গে ডেনমার্কের যুদ্ধ হইয়াছিল। একটি যুদ্ধের পর অনেকগুলি আহত লোক যুদ্ধেক্ষেত্রে পড়িয়াছিল। তাহাদের মধ্যে একজন ডেন সৈনিকের সঙ্গে এক বোতল জল ছিল। বোতল খুলিয়া সে সবেমাত্র জল পান করিতে যাইবে, এমন সময় সে শুনিতে পাইল একটু দূরে কে যেন যন্ত্রণায় কোঁকাইতেছে। শুনিয়া তাহার মনে ভারি দয়া হইল; সে টানিয়া হ্যাঁচড়াইয়া কোনরকমে সেই লোকটির কাছে গিয়া দেখিল সে একজন শত্রুপক্ষীয় সুইড। কিন্তু ডেন সৈনিকটি শত্রুমিত্র বিচার না করিয়া মুমূর্ষু শত্রুর মুখের কাছে বোতল লইয়া বলিল, ‘আহা! তোমার বড় বেশি আঘাত লাগিয়াছে— এই জল খাও।’ সুইড সৈনিক এক মুহূর্ত কি ভাবিয়া, হঠাৎ এক পিস্তল তুলিয়া জলদাতার কাঁধে গুলি করিল। ডেন বেচারী, শত্রুর উপকার করিতে গিয়া আবার সাংঘাতিকভাবে আহত হইয়া পড়িয়া গেল।</p> <p>এমন করিলে কাহার না রাগ হয়? ডেন চীৎকার করিয়া বলিল, ‘হতভাগা, আমি তোকে জল দিতে গেলাম, আর তুই আমায় খুন করিতে উঠিলি? দাঁড়া, তোকে আমি আচ্ছারকম শাস্তি দেই। আগে সবটা জল তোকে দিতেছিলাম, এখন অর্ধেকের বেশি কখনই দিব না।’ এই বলিয়া সে বোতলের জল খানিকটা পান করিয়া, তারপর বোতলটা শত্রুর হাতে গুঁজিয়া দিল।</p> <p>বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখকের মূল বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।<br />  </p>