<p>নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার-এ আক্রান্ত রোগীদের বলা হয় নার্সিসিস্ট। নার্সিসাস ছিলেন গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত এক চরিত্র। পুরাণ অনুযায়ী নার্সিসাস ছিলেন অসাধারণ সুন্দর যুবক। নদীর দেবতা সেফিয়াস এবং নীল অপ্সরী লিরিওপের পুত্র ছিলেন তিনি। তবে রূপবান নার্সিসাস শিশুকাল থেকেই ছিলেন আত্মগর্বিত ও প্রচণ্ড অহংকারী।</p> <p>এমন কোনো অপ্সরী নেই যে নার্সিসাসের প্রেমে পড়েনি। কিন্তু নার্সিসাস মনে করতেন তার যোগ্য ও সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি যখন জানতে পারতেন কোনো অপ্সরী তার প্রেমে পড়েছে, তাহলে সেই অপ্সরীকে তিনি কঠিন ভাষায় অপমান করতেন।</p> <p>মিথোলজিতে নার্সিসাসের নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হিসেবে দেবী অপ্সরী ইকোর নামটি উল্লেখযোগ্য।ইকো (Echo) শব্দটির উৎপত্তি এই বিখ্যাত গ্রিক দেবীর কাছ থেকেই হয়েছে। সে প্রসঙ্গ থাক।</p> <p>ইকো সংগীতের দেবীদের মধ্যে অন্যতম সুন্দরী। অপূর্ব মিষ্টি কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি ছিলেন বিখ্যাত। তিনি বাস করতেন গভীর জঙ্গলে ও পাহাড়ে।</p> <p>নার্সিসাস প্রায়ই তার অনুসারীদের নিয়ে জঙ্গলে শিকার করতে আসতেন। একদিন ইকো নার্সিসাসকে দেখে ফেললেন এবং দেখামাত্রই ভালোবেসে ফেলেন। লাভ এট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে আর কি!</p> <p>জঙ্গলের দেবতার অভিশাপে অভিশপ্ত ইকো নিজ থেকে কথা বলতে পারতেন না, অন্যজন কোনো কথা বললে তিনি কেবল সেই কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারতেন।</p> <p>নার্সিসাস এভাবে যখনই শিকারে আসতেন ইকো তাকে অনুসরণ করতেন। একদিন নার্সিসাস তার দল থেকে আলাদা হয়ে পড়লেন। কাউকে না পেয়ে চিৎকার করে বললেন, 'এখানে কেউ আছ?'</p> <p>তখন ইকো উত্তর দিলো 'কেউ আছ?' নার্সিসাস যাই বলেন অপ্সরী ইকো আড়াল থেকে হুবহু তার পুনরাবৃত্তি করেন।<br /> একসময় নার্সিসাস বললেন, 'কাছে আসো, এসো আমরা পরস্পরকে দেখা দিই'। ইকো ঠিক এই কথার অপেক্ষায় ছিলেন। নার্সিসাসের সামনে এলেন ইকো। প্রেমান্ধ ইকো যখন নার্সিসাসকে ছুঁয়ে দেখতে গেলেন অহংকারী নার্সিসাস তখন তার কাছ থেকে এক ঝটকায় সরে গেলেন এবং বললেন, 'তুমি কাছে আসার থেকে আমার মৃত্যু ভালো'।</p> <p>নার্সিসাস নিজের প্রতি এতই মগ্ন ছিলেন যে সবাইকে তার অযোগ্য মনে করতেন।</p> <p>লজ্জিত ও বিমর্ষ ইকো তখন থেকে পাহাড়ের গুহায় বসবাস করা শুরু করলেন। যাবার আগে নার্সিসাসকে অভিশাপ দিয়ে যান যে তার এই অতি অহংকারের কারণেই তার পতন হবে।</p> <p>অপমানে, বেদনায় ও যন্ত্রনায় ধীরে ধীরে ইকোর শরীরের চামড়া ও মাংস শুকিয়ে গেল এবং তার হাড়গুলো পরিণত হলো শক্ত পাথরে। পৃথিবীতে তার একটিমাত্র জিনিসই রয়ে গেল...তার কণ্ঠস্বর। আজও কেউ বনে বা পাহাড়ে গিয়ে কিছু বললে ইকো সেটার জবাব দেন।<br /> নার্সিসাস নিজের রূপ নিজ চোখে স্পষ্টভাবে কোনোদিন দেখেননি। সবার কাছ থেকে শুনে শুনেই বড়ো হয়েছেন যে তিনি অসাধারণ রূপবান। আর এতেই তার অহংকারের সীমা ছিল না। একদিন হরিণ শিকার করার পর ক্লান্ত নার্সিসাস পানির আশায় নদী তীরে এলেন। নার্সিসাস যখন পানি পান করার জন্য নিচু হলেন তখনি প্রথমবারের মতো নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। পানিতে প্রতিফলিত নিজের অসাধারণ রূপ দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে বারবার বলতে লাগলেন, 'এত সুন্দর! এত সুন্দর!'</p> <p>কিন্তু নার্সিসাস যখন বুঝতে পারলেন তিনি নিজেরই প্রেমে পড়েছেন এবং নিজেকে আপন করে পাওয়া, মৈথুন করা সম্ভব নয়—ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার রোগে আক্রান্ত হন। পানাহার ত্যাগ করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।</p> <p>তার মৃত্যুর পর দেবতারা তাকে অপূর্ব একটি সাদা ফুলে রূপান্তরিত করেন। ড্যাফোডিল গোত্রীয় 'নার্সিসাস' ফুলটির নাম এসেছে এই রূপবান নার্সিসাসের নাম থেকেই।</p> <p>আর এই মিথ থেকেই নার্সিসিজম ও নার্সিসাস্ট টার্ম দুটোর উৎপত্তি। এখান থেকেই অতিমাত্রিক আত্মপ্রেমসূচক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের নামকরণ করা হয় নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। সাইকিয়াট্রিস্টরা একে সংক্ষেপে নামকরণ করেন এনপিডি।<br /> লেখক: চিকিৎসক ও কথা সাহিত্যিক</p>