<p>১৯০৮ সনের ৩০ জুন। মধ্য সাইবেরিয়ার টাঙ্গুস্কায় ভোরের আলো সবে উঁকি দিচ্ছে। চারিদিকে বিরান বনভূমি। জনবিরল এই তাইগা অঞ্চল বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে। কিন্তু জুনের শেষে বরফ তখন আর নেই। গাছে গাছে সবুজ পাতার হিল্লোল। বড়ই মনোরম সুন্দর পরিবেশ। এই সুন্দর পরিবেশের মধ্যে হঠাৎ করেই একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে গেল।</p> <p>কথা নেই, বার্তা নেই টাঙ্গুস্কার আকাশে আচমকা একটি ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের শকওয়েভ কয়েকশো মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। তিনশো মাইল দূরের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানালো, তারা বিস্ফোরণের আগে সূর্যের মত উজ্জ্বল একটি বস্তুকে আকাশে প্রচন্ড গতিতে ছুটে যেতে দেখেছে। তার পরপরই বিস্ফোরণটি ঘটেছে। বিস্ফোরণের সময় তাদের মনে হয়েছিলো সমস্ত আকাশ যেন বিদীর্ণ হয়ে গেছে।</p> <p>বিস্ফোরণটি যেহেতু জনবিরল এলাকায় ঘটেছিল তাই মানুষের প্রাণহানির কোন খবর পাওয়া যায়নি। তবে কয়েক হাজার মাইল দূরে প্যারিস এবং লন্ডনের সিসমোগ্রাফে এই বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ভূকম্পনটি ধরা পড়েছিলো। এই বিস্ফোরণটি যখন ঘটেছিলো তখন রাশিয়ায় জারের রাজত্ব চলছে। সুদূর সাইবেরিয়ায় এই বিস্ফোরণের খবর মস্কোর ক্রেমলিনে জারের প্রাসাদে পৌঁছালেও এনিয়ে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। </p> <p>বলশেভিক বিপ্লবের পর, সোভিয়েত রাশিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার টাঙ্গুস্কার সেই দুর্গম অঞ্চলে একটি সাইন্টিফিক টিম পাঠালেন বিস্ফোরণের ঘটনাটি অনুসন্ধান করার জন্য। তখন অনেক বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও সেই টিমের সদস্যরা সেখানে গিয়ে যা দেখলেন, সেটি ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। তারা তাদের জরিপে দেখলেন, প্রায় দুই হাজার বর্গ কিলোমিটার বনভূমির আট কোটি বৃক্ষ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ মৃত বৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত হয়ে মাটিতে শুয়ে আছে। সেখানে নতুন কোন গাছপালা আর জন্ম নেয়নি। বিস্ফোরণের ধ্বংসলীলা তখনো সেখানে বিদ্যমান।</p> <p>বিজ্ঞানীদের ধারণা, আকাশ থেকে কোন বিশাল বস্তু সেদিন টাঙ্গুস্কাতে এসে আঘাত হেনেছিল। কিন্তু বস্তুটি কী ছিল সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারলেন না। কারণ এটা যদি কোন বিশাল উল্কাখন্ড হতো তাহলে ভূমিতে বিরাট গর্ত সৃষ্টি হতো। উল্কাখন্ডের নমুনাও পাওয়া যেত। কিন্তু ভূমিতে এমন কোন আলামত পাওয়া গেল না। তাই তারা ধারণা করলেন, বিস্ফোরণটি ভূমিতে নয় বরং আকাশে হয়েছিলো।</p> <p>পরবর্তীতে টাঙ্গুস্কাতে আরো অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে সেদিন টাঙ্গুস্কার আকাশে প্রায় ১৫ মেগাটন টিএনটির সমপরিমাণ বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। এটি ছিলো হিরোসিমাতে ব্যবহৃত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখলেন ৫০ থেকে ১০০ মিটার সাইজের একটি বস্তু প্রায় ১১ কিলোমিটার/সেকেন্ড গতিতে মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সেদিন প্রবেশ করেছিল।</p> <p>বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর বাতাসের সাথে সংঘর্ষে বস্তুটি সম্পূর্ণ বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণ থেকে ১৫ মেগাটন টি এন টির সমপরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়েছিল এবং শকওয়েভের আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিস্ফোরণটি ঘটেছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার উপরে। সেজন্য ভূমিতে কোন গহ্বর সৃষ্টি হয়নি। তারা এটাও বললেন, ঘটনাটি আর কয়েক ঘন্টা পরে হলে, পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য, এটি লেনিনগ্রাদ বা মস্কোর উপরও হতে পারতো। তাহলে পুরো শহরই ধ্বংস হয়ে যেত এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাতো। মানুষের ভাগ্য ভাল যে, ঘটনাটি জনবহুল এলাকায় ঘটেনি, ঘটেছে বিরানভূমিতে।</p> <p>পৃথিবীতে প্রতিদিনই ছোটখাটো উল্কাপাত হয়। বেশিরভাগ উল্কাপিণ্ডই বায়ুমন্ডলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু উল্কাখন্ড মাটিতে এসে পৌঁছায়। সেগুলি অবশ্য বড় আকারের কিছু নয়। সাধারনত ছোট বা মাঝারি শিলাখণ্ডের আকৃতির হয়। এগুলো পৃথিবীর জন্য হুমকি নয়।<br /> কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানেন, সৌরজগতে মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাঝেমাঝি অঞ্চলে ছোট বড় প্রচুর গ্রহাণু (asteroid) ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন কোন সময়ে পৃথিবীর কক্ষপথে সেগুলো চলে আসে। এসব গ্রহাণু যদি কখনো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের আওতায় চলে আসে তবে পৃথিবীর সাথে এদের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তখন এসব গ্রহাণু পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। মহাকাশ বিজ্ঞানের পরিভাষায় এদেরকে বলা হয়, নিয়ার আর্থ অবজেক্ট (Near Earth Object) সংক্ষেপে বলে নিও (NEO)। </p> <p>নাসা (NASA) পৃথিবীর কাছাকাছি এসব নিও গ্রহাণুর উপর কড়া নজর রাখছে। ইতিমধ্যেই ২০ হাজারের বেশি নিও গ্রহাণুকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। নাসার তথ্য অনুযায়ী অদূর ভবিষ্যতে এসব বস্তুর পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু এই সম্ভাবনা একেবারেই নাকচ করে দেওয়া যায় না। </p> <p>অতীতে টাঙ্গুস্কার মত অসংখ্যবার পৃথিবীতে এ ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। তার অনেক প্রমাণও রয়েছে বিজ্ঞানীদের হাতে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়ার কারণ হলো এরকম একটি বিশাল সংঘর্ষ। ভবিষ্যতে এরকম আরেকটি সংঘর্ষ আদৌ যে হবে না, তা কি হলফ করে কেউ বলতে পারে? অতীতে যখন সংঘর্ষ হয়েছে, ভবিষ্যতেও সেটা হবে, একথা বলাই বাহুল্য। প্রফেসর স্টিফেন হকিংয়ের মতে, এ ধরনের মহাজাগতিক সংঘর্ষ মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য একটি প্রধান হুমকি। </p> <p>বিজ্ঞানীদের জানামতে বর্তমানে কোন গ্রহাণু পৃথিবীর জন্য হুমকি নয়। তবে তাঁরা এটাও জানেন, এখনো অনেক নিয়ার আর্থ অবজেক্ট রয়েছে তাঁদের অগোচরে। হঠাৎ করেই পৃথিবীর আকাশে এদের উদয় হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। যেমন, ২০১৩ সালে রাশিয়ার আকাশে হঠাৎ করেই ২০ মিটার সাইজের একটি বস্তু প্রচন্ড গতিতে এসে বিস্ফোরিত হয়েছিলো। আচমকা এই বিস্ফোরণের শক ওয়েভের ফলে অনেক দালানকোঠার দরজা জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। এতে প্রায় চৌদ্দশ মানুষ আহত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালেও কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই, ১৩০ মিটার সাইজের একটি গ্রহাণু পৃথিবীর ৭২ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছিলো। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, এর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ হওয়ার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। </p> <p>নিয়ার আর্থ অবজেক্টের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য নাসা একটি বিশেষায়িত ইনফ্রারেড স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর নাম হলো, নিও সার্ভিলেন্স মিশন। ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই টেলিস্কোপটি উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থারও এ ধরনের স্পেস টেলিস্কোপ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি সত্যি সত্যিই পৃথিবীর দিকে কোন গ্রহাণু ধেয়ে আসে, তবে তাকে ঠেকানোর উপায় কী? </p> <p>অনেকে বলেন, দূরপাল্লার মিসাইল ছুঁড়ে গ্রহাণুর বুকে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওটাকে ধ্বংস করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ গ্রহাণুটি তখন কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। তারপর গ্রহাণুটির একাধিক তেজস্ক্রিয় খন্ড পৃথিবীতে এসে আঘাত হানতে পারে। এতে বিপদ আরো বাড়বে। অনেকে বলেন, সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হলো গ্রহাণুর উপর বিশেষ ধরনের মহাকাশযান অবতরণ করিয়ে, রকেট সঞ্চালনের (rocket propulsion) মাধ্যমে গ্রহাণুটির গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়া। এতে গ্রহাণুটি পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাবে।</p> <p>আশার বিষয় হলো, ইতিমধ্যেই মানুষ গ্রহাণুর উপর মহাকাশযান অবতরণ করানোর প্রযুক্তি অর্জন করেছে। ২০০১ সালে নাসার একটি মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান (NEAR) ইরোস (Eros) নামের একটি গ্রহাণুর উপর সফলভাবে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিলো। তারপর ২০১৯ সালে জাপানি মহাকাশ সংস্থার একটি রোবটিক মহাকাশযান (Hayabusa 2) রাইউগু নামের একটি গ্রহাণুর উপর সফলভাবে নামতে সক্ষম হয়। এই গ্রহাণুটি থেকে কিছু পরিমাণ ধূলিকণা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার জন্য পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। </p> <p>২০২২ সালের অক্টোবর মাসে নাসার OSIRIS-REx মহাকাশযান বেনু (Bennu) নামের একটি ছোট্ট গ্রহাণু থেকে সামান্য পরিমাণ নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছে। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন ২১৭৫ থেকে ২১৯৯ সালের মধ্যে বেনু নামের এই গ্রহাণুটির সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ হওয়ার একটি ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং এর গঠন সম্বন্ধে জানা থাকলে, আগেভাগেই একে ধ্বংস করা সহজ হবে।<br /> অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন মানব সভ্যতার ওপর সবচেয়ে ভয়ংকর আঘাতটি আসতে পারে পৃথিবীর সাথে মহাকাশের কোন গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে। এর ফলে মানব সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সুদূর অতীতে এরকম একটি মারাত্মক সংঘর্ষের ফলে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মহাকাশ থেকে ছুটে আসা কোন গ্রহাণুর সাথে সম্ভাব্য আঘাতের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আগেভাগেই জোরদার করতে হবে।</p> <p>এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা অবশ্য বসে নেই। ২০২১ সালে নাসা, ডাবল অ্যাস্টারয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট বা ডার্ট নামে একটি মহাকাশ যান উৎক্ষেপণ করেছিল। এর কাজ ছিল, ডাইডায়মস/ডায়মরফস নামের জোড়া গ্রহাণুর একটিকে আঘাত করে এর গতিপথ পরিবর্তন করা। মহাকাশে ডাইডায়মস নামের একটি ৭৮০ মিটার বাসের গ্রহাণুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে ডায়মরফস নামের একটি ১৬০ মিটার ব্যাসের ছোট গ্রহাণু। পাঁচশ কিলোগ্রাম ওজনের ডার্ট মহাকাশযানটি সেকেন্ডে ৬.৬ কিলোমিটার বেগে ডায়মরফস গ্রহাণুটাকে প্রচন্ড আঘাত হেনেছে। এই পরীক্ষাটি করা হয়েছে ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। এই আঘাতের ফলে ডায়াফরমস গ্রহাণুটির ঘূর্ণনের বেগ কিছুটা কমে গেছে। এর ফলে দুটো গ্রহাণুর গতিপথে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন হবে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। </p> <p>এই সফল পরীক্ষাটির ফলে ভবিষ্যতে মানুষ গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করার মত আরো নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারবে বলে আশা করা যায়। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে পৃথিবীর সাথে কোন গ্রহাণুর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠলে সেটার গতিপথ পরিবর্তন করে সংঘর্ষ এড়ানো যাবে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য মনে করেন, এর জন্য ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক আরো সহযোগিতা দরকার হবে। সেই লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থার বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষকে হয়তো ডাইনোসরের ভাগ্য বরণ করতে হবে না। ক্ষুদ্র মানুষ তার মেধা খাটিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে বহুকাল, মানুষ হিসেবে এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।<br />  </p>