<p><a href="https://www.kalerkantho.com/online/science/2024/01/25/1357872"><span style="color:#2980b9;">এক্স রে আবিষ্কারের পর রন্টজেন </span></a>সবার আগে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন আরেক ফরাসী বিজ্ঞানী, হেনরি পয়েনকেয়ারকে। সেই পয়েনকার, সাধারণ আপেক্ষিতা নিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে যাঁর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমে উঠেছিল। পয়েনকেয়ারকে অনেক বিশ্বাস আর ভক্তি করতে রন্টজেন। </p> <p>তাই রন্টজেনের আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন পয়েনকেয়ারই। একদিন এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হচ্ছিল ফ্রান্সে। অনেক দামি-দামী ফরসী বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। সেখানে পয়নকেয়ার রন্টজেনের আবিষ্কারটা দেখান। সেই সম্মেলনে হাজির ছিলেন হেনরি বেকরেল নামে আরেক তরুণ বিজ্ঞানী। রন্টজেনের আবিষ্কার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পয়নকেয়ারকে জিজ্ঞেস করেন, ক্যাথোড টিউবের ঠিক কোথায় এক্স রশ্মি দেখা যাচ্ছে। পয়েনকার জানালেন ক্যাথোডের বিপরীত দিকে যেখানে উজ্জ্বল প্রতিপ্রভা তৈরি হয়, সেখানেই আসলে এক্স রশ্মি উত্পন্ন হচ্ছে।</p> <p>বেকরেল ভাবলেন, প্রতিপ্রভা আর এক্সরশ্মির নিশ্চয়ই কোনো সমপর্ক আছে। বেকরেল উত্সাহী হয়ে ওঠেন এক্স রশ্মিতে। এর কারণও আছে। বেকরেলের পরিবারে রয়েছে পদার্থবিদ্যাচর্চার ঐতিহ্য। বিকিরণ বিষয়ে উত্সাহী তাঁরা তিন পুরুষ ধরে। বেকরেলের পিতামহ অ্যান্টনি বেকরেল পদার্থবীজ্ঞানী ছিলেন। তিনি বিদ্যুৎ নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন। লিখেছেন পাঁচ শরও বেশি পাঠ্য বই। তাঁর ছেলে অর্থাৎ হেনরির বাবা অ্যান্টনির ছেলে এডমন্ড বেকরেলও পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। ইউরেনিয়ামের প্রতিপ্রভা বিকিরণ নিয়ে উত্সাহী ছিলেন। বিকিরণ পরিমাপের জন্য তিনি একটি যন্ত্রও তৈরি করেন। এমন একটা পরিবারে জন্ম যাঁর, তিনি প্রতিপ্রভা বা বিকিরণ নিয়ে উত্সাহী হবেন সেটা খুব স্বাভাবিক।</p> <p>পয়েনকেয়ারের সঙ্গে আলোচনার পর হেনরি কাজে লেগে পড়েন। ইউরেনিয়ামের মতো প্রতিপ্রভা বিকিরণকারী বস্তু এক্সরশ্মি বিকিরণ করে কিনা সেটা দেখতে চাইলেন হেনরি।</p> <p>রন্টজেন যখন এক্স-রে আবিষ্কার করছেন তখন হেনরি ইকোল পলিটেকনিকের অধ্যাপক হন। সঙ্গে গবেষণাও চলে। প্রতিপ্রভার ওপর লেখেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। কিন্তু আসল পরীক্ষায় তিনি ব্যর্থ।</p> <p>কোন পরীক্ষা?</p> <p>ওই যে, প্রতিপ্রভা বিকিরণ করে যেসব বস্তু, সেগুলো কি একাস রশ্মি বিকিরণ করে? বেকরেল এটা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা শুরু করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফল আসে নেগেটিভ —কোনো প্রতিপ্রভা বিকিরণকারী পদার্থেই তিনি এক্স রশ্মির হদিস পেলেন না।</p> <p>১৮৯৫ সালের শুরুতে পয়েনকেয়ার একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এক্স রশ্মি নিয়ে। সেই প্রবন্ধে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে। বলেন, যেসব বস্তু তীব্র প্রতিপ্রভা বিকিরণ তারা কি দৃশ্যমান আলো আর এক্স-রে একই সঙ্গে বিকিরণ করে?</p> <p>পয়েনকেয়ারের এই প্রশ্নটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন বেকরলে, নতুন করে শুরু করেন তাঁর পরীক্ষা। এবার তিনি পরীক্ষার নতুন উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করলেন পটাশিয়াম ইউরেনাইল সালফেট। এটা ইউরোনিয়ামের একটা লবণ।</p> <p>এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি। তখনকার যুগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোকরশ্মি নিঃসরণ অর্থাৎ প্রতিপ্রভা বিকিরণকারী যৌগগুলোকে ফসফরোসেন্ট পদার্থ বলতেন বিজ্ঞানীরা। এই যৌগগুলো আলো বা তাপ শক্তি শোষণ করে। তারপর ধীরে ধীরে বিকিরণ করে আলো। শক্তির যোগান বন্ধ হওয়ার পরও বহুক্ষণ ধরে চলে আলো বিকিরণ প্রক্রিয়া। আরেক ধরনের পদার্থ আছে, যারা ফ্লোরোসেন্ট। শক্তির যোগান বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে এদের বিকিরণও বন্ধ হয়ে যায়। বেকরেল যেটা ব্যবহার করেন, সেটা হলো নাম পটশিয়াম ইরোনাইল সালফেটের একটি ক্রিস্টাল।</p> <p>এটা আসলে এক ধরনের ফসফরোসেন্ট যৌগ। তাই এটা শক্তি শোষণ করে অনেক্ষণ ধরে আলোক রশ্মি বিকিরণ করতে পারে। বেকরেল দেখতে চেয়েছিলেন এই ক্রিস্টালটি যখন আলোকরশ্মি বিকিরণ করে তখন অন্য আলোর পাশাপাশি এক্স রশ্মিইও বিকিরণ করে কি-না।<br /> বেকরেল একটা ফটোগ্রাফিক প্লেটকে পুরো কালো কাগজ দিয়ে মোড়ালেন। তারপর সেটাকে রাখলেন সূর্যের আলোতে। সূর্যের আলোক রশ্মি সেই কালো কাগজ ভেদ করে প্লেটের ওপর পড়বে না। বেকরেল কালো কাগজটির ওপর রাখলেন পটাশিয়াম ইউরোনাইল ফসফেটের সেই ক্রিস্টাল। সূর্যের সাধারণ আলো অত মোটা কালো কাগজ ভেদ করে ঢুকতে পারবে না ফটোগ্রাফিক প্লেটে। ঢুকতে পারবে না ক্রিস্টাল যেসব দৃশ্যমান আলোক রশ্মি বিকিরণ করে সেগুলোও। কিন্তু ক্রিস্টালটা যদি এক্স-রশ্মি বিকিরণ করে তাহলে সেটা ঢুকে পড়বে কালো কাগজ ভেদ করে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে সেই রশ্মির ছাপ পড়বে। কয়েক ঘণ্টা রোদে রেখে দিলেন সেগুলো। পরে বেকরেল সবগুলো জিনিস তুলে নিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরিতে। কালো কাগজ সরিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটটাকে ডেভেলপ করলেন।</p> <p>দেখলেন, তাঁর অনুমানাই ঠিক। ফসফরোসেন্ট ক্রিস্টালটি সত্যি সত্যিই এক্স-রে বিকিরণ করেছে। সেই বিকিরণের ছাপ দেখা গেছে প্লেটে। অনুমান তো ঠিক হলো। এটা তো অন্যদেরও জানাতে হবে। তার আগে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া চাই।</p> <p>এজন্য বেকরেল আরেকবার করতে চইলেন পরীক্ষাটি। সবকিছু আগের মতো করে প্রস্তুত করলেন। কিন্তু কপাল মন্দ তাঁর। হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল আবহাওয়া। মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলল সূর্য। সুতরাং আর এগুবে না পরীক্ষা। যতদিন আবহাওয়া ভালো নয়, ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।</p> <p>কালো কাগজ মোড়ানো প্লেট আর ক্রিস্টালটাকে তুলে নিয়ে এলেন। তারপর সেগুলো ঢুকিয়ে রাখলেন ল্যাবরেটরির ড্রয়ারে। বেশ কয়েকদিন আবহাওয়া খারাপ হয়ে ছিল। তর সইছিল না বেকরেলের। কিছু একটা করতে হবে। তাই ড্রয়ারে রাখা কালো কাগজ মোড়া প্লেট, ক্রিস্টাল বের করলেন সব। প্যাকেট খুলে প্লেটটা ডেভেলপ করলেন। ডেভেলপ করা প্লেটের দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন বেকরেল। প্লেটের ওপর ঝাপসা আলোর রেখা।</p> <p>এটা এলো কোথা থেকে? আশপাশে চালু অবস্থায় কোনো এক্স-রে উত্সও নেই। তারমানে কোনো রকম শক্তি শোষণ না করেই ফসফরোসেন্ট কিস্টালটি এক্স-রে বিকিরণ করেছে! একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এটা বিজ্ঞান ইতিহাসের আরেকটি যুগন্তকারী ঘটনা।</p> <p>এর ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন বেকরেল। তারপর আবিষ্কার করলেন, এই ঘটনাটির জন্য পুরো কিস্টালটি দায়ী নয়। পটাশিয়াম ইউরেনিয়াল সালফেট ক্রিস্টালের প্রতিটা অণুতে একটা করে ইউরেনিয়াম পরমাণু থাকে। সেই পরমাণুই আসলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক্স-রে বিকিরণ করেছে।<br /> ইউরেনিয়ামযুক্ত আরও কিছু যৌগ নিয়েও পরীক্ষা করেছিলেন। সবগুলোতেই একই ফল পাওয়া গেল। তারমানে ইউরেনিয়াম পরমাণুর বিশেষ ক্ষমতা আছে রশ্মি বিকিরণ করার। তবে বেকরেল কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না বিকিরিত এই রশ্মিগুলো এক্স-রে কিনা। তাই তিনি সেই বিকিরণের নাম দিলেন ইউরেনাইল রশ্মি। পরে ফরাসী বিজ্ঞানী মেরি কুরি এ ধরনের সকল রশ্মির নাম দিলেন তেজস্ক্রিয় রশ্মি। যেসব মৌল তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকরণ করে তাদের নাম দেওয়া হলো তেজস্ক্রিয় পদার্থ।<br />  </p>