<p>প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম হয়েছিলো ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার ঝিনাইদহে। তাঁর বাবা ছিলেন মহকুমা মুন্সেফ। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় তাঁকে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। স্কুলে থাকতেই অংকের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। জটিল অংকের সমাধান খুব সহজেই করতে পারতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানেও আগ্রহ ছিল প্রবল। পরবর্তীতে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি অংকে অনার্স সহ বিএসসি পাস করেন। </p> <p>ষাটের দশকের শুরুতে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনা করতে যান তিনি। সেখানে ফলিত গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। তারপর কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো কসমোলজি (Cosmology)। এটা হলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা। এর বিষয়বস্তু হচ্ছে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, বিবর্তন এবং ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে গবেষণা করা। </p> <p>কসমোলজিস্টদের মতে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের (Big bang) ফলে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। তাঁদের ধারণা বিগ ব্যাং থেকেই মহাবিশ্বের যাবতীয় প্রাথমিক বস্তুকণার সৃষ্টি হয়। মহাবিস্ফোরণের শক্তি থেকে প্রাথমিক বস্তুকণার রূপান্তর কিভাবে হয়েছিল তাঁর ব্যাখ্যা তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, মহাবিস্ফোরণের ফলে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় প্রচন্ড শক্তি নির্গত হয়েছিল। ট্রিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রার এই শক্তি থেকে খুব দ্রুতই কিছু প্রাথমিক বস্তুকণার উদ্ভব হয়। যেগুলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এর পরপরই মহাবিশ্বের প্রসারণ শুরু হয় এবং এখনো তা ক্রমেই প্রসারিত হয়েই চলেছে। পরবর্তীতে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণু মহাকর্ষের ফলে পুঞ্জীভূত হয়ে বিভিন্ন নক্ষত্র, নেবুলা এবং গ্যালাক্সির জন্ম দিয়েছে, যা এখন আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের অংশ। ষাটের দশকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিগ ব্যাং থিওরি বিজ্ঞানী মহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। </p> <p>কিন্তু ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের পরিণতি কি হতে পারে এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সংশয় ছিল। ডক্টর জামাল নজরুল ইসলাম এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ১৯৭৭ সনে তিনি মহাবিশ্বের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নালে। তাঁর গবেষণাটি বিজ্ঞানী মহলে সর্বত্র প্রশংসিত হলো। পরবর্তীতে (১৯৮৩) তিনি এই বিষয়টি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশ করলেন। বইটির নাম তিনি দিয়েছিলেন, ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অফ দ্য ইউনিভার্স’। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। এই বইটিতে তিনি মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি কি হতে পারে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নির্ভর করছে এর সামগ্রিক ভর এবং বিস্তারের উপর। মহাবিশ্বের প্রসারণ একসময় থেমে যাবে কি না এবং মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সেটা আবার সংকুচিত হয়ে মহাবিস্ফোরণের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে কিনা সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে মহাবিশ্বের সার্বিক ঘনত্বের উপর। সুদূর ভবিষ্যতে পুরো মহাবিশ্বটাই একটি বিশাল ব্লাকহোলে (Blackhole) পরিণত হওয়াটাও বিচিত্র কিছু নয়। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি যখন হয়েছে তখন তার ধ্বংসও অনিবার্য। </p> <p>বিজ্ঞানী মহলে তাঁর পরিচয় ছিল জে এন ইসলাম নামে। পরবর্তীতে তিনি কেমব্রিজ ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতেও কসমোলজি নিয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন। গবেষণার সুবাদে বিশ্বের অনেক নামিদামি বিজ্ঞানীর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল। কেমব্রিজে থাকার সময় প্রফেসর স্টিফেন হকিং ছিলেন তাঁর বন্ধু ও সহপাঠী। কসমোলজি নিয়ে প্রফেসর ইসলামের প্রচুর গবেষণা রয়েছে। তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম সারির একজন কসমোলজিস্ট।</p> <p>ইংরেজি ভাষায় তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি' (১৯৮৫) এবং ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি' (১৯৯২)। তাঁর লেখা বইগুলো কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন, হার্ভার্ডের মতো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় ছিল। </p> <p>আশির দশকে (১৯৮৪) প্রফেসর জে এন ইসলাম বিদেশে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজ ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি যোগদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল চট্টগ্রামে। সেজন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি তাঁর কর্মস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি স্থাপন করেছিলেন, রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল এন্ড ফিজিক্যাল সাইন্সেস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে অনেক বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রী উচ্চতর গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছেন। গবেষক হিসেবে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশ একদিন বিজ্ঞান গবেষণায় অনেক এগিয়ে যাবে। </p> <p>প্রফেসর জে এন ইসলাম ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। দেশমাতৃকার টানে তিনি বিদেশের উচ্চ বেতন এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ছেড়ে চলে এসেছিলেন নিজ বাসভূমে শিক্ষকতার মহান পেশা নিয়ে। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী এবং শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। বাংলাভাষাকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করতেন। ব্ল্যাকহোল নিয়ে তিনি বাংলায় একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম হলো ‘কৃষ্ণবিবর’। এটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা’ নামে তাঁর আরেকটি বই আছে।</p> <p>প্রচার বিমুখ প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হাতে গোনা যে কয়জন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছেন তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কসমোলজিতে তাঁর মৌলিক গবেষণা পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকদের অনুপ্রাণিত করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাসের মর্যাদা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও তাঁকে একুশে পদক দেয়া হয়েছিলো। </p> <p>প্রফেসর জে এন ইসলাম ২০১৩ সালে নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। প্রথিতযশা বাংলাদেশী এই বিজ্ঞানীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।</p> <p>আজ প্রফেসর জে এন ইসলামের জন্মদিনে তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।</p>