<p>পৃথিবী লাটিমের মতো ঘুরছে—বইয়ের এক জায়গায় এমন এক উপমা দেখে অমিত সুবিদ হাসানকে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার পৃথিবী যে লাটিমের মতোই ঘুরছে সেটা বিজ্ঞানীরা জানল কী করে?’</p> <p>প্রশ্নটা শুনে সুবিদ হাসান অমিতকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে সব উপমাকে বিজ্ঞানের মূল ধারার সাথে হুবহু মেলানোর চেষ্টা করাটা বোকামি। কারণ বাস্তবতার সাথে উপমার অনেক পার্থক্য থাকতে পারে।</p> <p>‘তাহলে স্যার, বইগুলোতে এরকম উপমা ব্যবহার করা হয় কেন?’ প্রশ্ন ফাতেমার।</p> <p>‘ভালো প্রশ্ন করেছিস। কিন্তু তোর উত্তরটা দিতে গেলে আমরা বিজ্ঞানের মূল আলোচনা থেকে সরে গিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষাবিষয়ক ভিন্নধর্মী আলোচনার পথে চলে যাব। তোরা যদি শুনতে চাস তো বলতে পারি।’</p> <p>সকলে সমস্বরে সুবিদ হাসানকে বলার জন্য অনুরোধ করল। শুরু করলেন সুবিদ হাসান।</p> <p>‘বিজ্ঞান শিক্ষাটাকে আমরা যা ভাবি তার থেকেও কঠিন। মানুষ একটা সময় প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করেছে এর বাইরের রূপ দিয়ে। কিন্তু বাইরের রূপ দিয়ে প্রকৃতিকে যে ঠিকমতো বোঝা যায় না সেটা বুঝতে পারলেন এক দল জ্ঞানী মানুষ। যেমন, বংশগতির জনক মেন্ডেল যখন জেনেটিকসের জন্য সূত্র আবিষ্কার করলেন, তখন তাঁকে কোষের ভেতরের কিছু একটাকে কল্পনা করে নিতে হয়েছিল, যেটার মাধ্যমে বংশের বৈশিষ্ট্যগুলো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে যায়। অথচ তিনি মটরশুঁটির শুধু বাইরের বৈশিষ্ট্যগুলোকেই দেখেছিলেন, এদের কোষের ভেতরে কী ঘটছে তা তাঁর জানা ছিল না। একটি প্রজাতির বাইরের বৈশিষ্ট্য বুঝতে গিয়ে তাঁকে এমন এক ফ্যাক্টর কল্পনা করে নিতে হয়েছিল, যেটা আসলে কী তা তিনি নিজেও জানতেন না। এরপর তো কোষের ভেতরকার সব খবরাখবর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে বের করে আনতে লাগলেন বিংশ শতাব্দীর জীববিজ্ঞানীরা।</p> <p>বিজ্ঞান যদি এরকমভাবে জনসাধারণের আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকে তবে তো বিজ্ঞানটা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞান তো সমাজ থেকে আলাদা কিছু নয়। বিজ্ঞান তত্ত্ব দেয়; প্রযুক্তিবিদরা সেই ধারণা কাজে লাগিয়ে এমন সব জিনিস আবিষ্কার করেন, যার ফল ভোগ করে সমাজের বাদবাকি সকলে। সুতরাং সমাজের সাথে বিজ্ঞানের যোগসূত্র খুঁজতে গেলে আমরা একেবারে বিজ্ঞানের মূলে গিয়ে হাজির হব। এমতাবস্থায় সমাজে যে বিজ্ঞানের আলাদা একটা কদর থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই কদর থেকেই বিজ্ঞান জানার প্রয়োজন হয়। ফলে মানুষ বিজ্ঞানের মৌলিক কিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বা গবেষকরা বা পেশাগতরা যেভাবে বিজ্ঞানটাকে বুঝতে পারে সেভাবে তো আর জনসাধারণ বা শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারবে না। এখন তোদেরকেই একটা প্রশ্ন করি- ‘তোদের মধ্যে সামনাসামনি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দেখেছিস কতজন?’</p> <p>পুরো ক্লাস চুপ। এর অর্থ ক্লাসে একজনও নেই যে কি না স্বচক্ষে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দেখেছে। </p> <p>সুবিদ হাসান বললেন, ‘তাহলেই বোঝ ব্যাপারটা। এতজন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনও যেখানে অণুবীক্ষণ যন্ত্র স্বচক্ষে দেখিস নাই, সেখানে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে কোষ দেখার প্রশ্নই তো ওঠে না। সেক্ষেত্রে একজন জীববিজ্ঞানী তোকে কী করে বোঝাবে যে কোষ জিনিসটা আসলে কী! তোরা তো তাও বইতে কোষের ছবি দেখেছিস, বহু মানুষ আছে যারা তাও দেখেনি। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে পৃথিবীটা অনেক ছোট হয়ে গেছে। </p> <p>পশ্চিমাদের শিক্ষার ঢেউ গিয়ে পড়ছে সর্বত্র। এখন সূর্যগ্রহণ হলেও দেশের সাধারণ এক লোকাল পত্রিকা সেটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। বড় ধরনের কোনো আবিষ্কার হলে সেটা নিয়ে ফিচার করে দৈনিক পত্রিকাগুলো, সাক্ষাৎকার নেয় বিশেষজ্ঞ বা অধ্যাপক পর্যায়ের কারও। পত্রিকা যেহেতু বিশেষ কোনো শ্রণিই শুধু পড়ে না, আমজনতা সকলেই পড়ে; সেহেতু বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে সকলের উপযোগী করে বোঝানোটা তাঁদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এইসকল পরিস্থিতিতে মানুষের জানা বাস্তব জগৎ থেকে বিজ্ঞানের কিছু উপমা ব্যবহার না করলেই নয়।’</p> <p>সুবিদ হাসান একটু থামলেন। এরপর রাতুলকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন, ‘বল তো রাতুল, কোনো পদার্থকে ভাঙতে থাকলে শেষে কি পাওয়া যাবে?’</p> <p>‘ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন।’</p> <p>‘ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি করে পরমাণু। তো পরমাণুতে এই কণাগুলো কীভাবে থাকে সেটা বের করাও একটা বিজ্ঞান। এটা বের করতে পারলে বস্তুজগতের বহু অজানা বিষয় জানা সম্ভব হবে। আমরা তো জানিই যে আজকের বিজ্ঞান আগামী দিনের বিজ্ঞান-পথকে অনেকটাই সহজ করে তোলে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে টমসন পরমাণুতে পজেটিভ আর নেগেটিভ- এই দুই ধরনের আধান বুঝতে পেরেছিলেন। এক বাটি পুডিং এর এখানে-সেখানে কিছু কিসমিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে সেটা যে রকম একটা জিনিস হয়ে দাঁড়ায়, টমসন পরমাণুকে ঠিক সেরকমই এক গঠন বলে কল্পনা করে নিয়েছিলেন। আবার ঈদের সময় বাসাবাড়িতে যে সেমাই রান্না করা হয়, সেই সেমাইয়ের এখানে-সেখানে কিছু কাজুবাদাম ছিটিয়ে দেয়া হয়। চাইলে এর সাথেও টমসনের পরমাণু মডেলটাকে কল্পনা করা যেতে পারে। এ ধরনের উপমায় টমসন সেমাই বা পুডিং-এর অংশটাকে পজেটিভ আধান বা প্রোটন, আর কাজুবাদাম বা কিসমিসগুলোকে নেগেটিভ আধান বা ইলেকট্রন বলে কল্পনা করেছিলেন।</p> <p>আরেক বিজ্ঞানী ও টমসনের ছাত্র রাদারফোর্ড, থমসনের সেই পুডিংএর কিসমিস মডেলটাকে বাতিল করে দিয়ে পরমাণুর জন্য ‘সৌরজগৎ মডেল’ কল্পনা করলেন। এই মডেলে নেগেটিভ আধান বা ইলেকট্রনগুলো থমসন-মডেলের কিসমিসের মতো স্থির হয়ে বসে নেই। আবার পজেটিভ আধান বা প্রোটনও বাটি জুড়ে থাকা পুডিং-এর মতো সমগ্র পরমাণু জুড়ে অবস্থান করছে না। তিনি নিউক্লিয়াসকে আস্ত এক পরমাণুর কেন্দ্রে সামান্য একটু জায়গা দিয়ে দিলেন, আর পরমাণুর বাকি অংশকে ইলেকট্রনের অঞ্চল বানিয়ে ফেললেন। এই অঞ্চলে থাকা ইলেকট্রনগুলো সেইসামান্য একটু জায়গা জুড়ে থাকা নিউক্লিয়াস কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। একটু চোখ বন্ধ করে ভাবলে মনে হবে যেন আমি সৌরজগতের কথা বলছি, যেখানে নিউক্লিয়াসটি সূর্য, আর ইলেকট্রনগুলো এই সূর্যকে ঘিরে ঘুরতে থাকা একেকটা গ্রহ। </p> <p>রাদারফোর্ড পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সাথে আরও একটি কণা থাকার কথা বললেন, যার নাম নিউট্রন। সুতরাং বুঝতেই পারছিস যে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের বোঝার জন্যই না, অন্য বিশেষজ্ঞরা যেন একজন গবেষকের একেবারে নতুন কোনো কাজকে সহজে বুঝতে পারেন সে জন্যও বিজ্ঞানে উপমা ব্যবহারের প্রচলন আছে। এর পেছনে অবশ্য কিছু যুক্তিসংগত কারণ যে নেই তাও না। প্রথমত, টমসন ও রাদারফোর্ড- দুজনেই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত থেকে নিজের মতো করে একটা মডেল বানিয়ে নিয়েছিলেন। যেহেতু তাঁরা কেউই পরমাণুর জগতে গিয়ে পরমাণু দেখতে কেমন সেটা দেখে আসেননি, সেহেতু এগুলো ছিল তাঁদের কল্পনার ফসল। কল্পনার সাথে বৈজ্ঞানিক যুক্তি যে ছিল না সেটা বলা যাবে না। থমসন এবং রাদারফোর্ড—দুজনেই পুরোপুরি বিজ্ঞানের নিয়মনীতি মেনে তবেই পরমাণুর মডেল দুটি তৈরি করেছিলেন। তাছাড়া ধারণাটি তখন বিজ্ঞানী সমাজে এতটাই নতুন যে এ ধরনের কিছু না কিছু উপমা না দিলে স্বয়ং বিজ্ঞানী সমাজই সেটা বুঝতে পারবে না, জনসাধারণ তো বহু দূরের বিষয়। </p> <p>উপমা ব্যবহারের আরও একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব। তোরা অনেকেই হয়তো জানিস যে আইনস্টাইন স্থান এবং কাল নিয়ে চারমাত্রার কথা বলেছিলেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি মৌলিক ধারণা এটি। মৌলিক ধারণা হওয়ায় আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার দ্বিতীয় তত্ত্বেও চারমাত্রা নিয়ে কাজ করেছেন। আপেক্ষিকতার এই দ্বিতীয় তত্ত্বটি মূলত মহাকর্ষের একটি তত্ত্ব। এখানে তোদের জানা নিউটনের মহাকর্ষ নীতি থেকে ভিন্ন কথা বলা হয়েছে। আইনস্টাইন তাঁর মহাকর্ষ তত্ত্বকে দেখেছেন স্থান-কালের বক্রতারূপে। তোদের খাতার পৃষ্ঠা একটা দ্বিমাত্রিক স্থান। সেটাকে তোরা চাইলেই বাঁকাতে পারবি, দুমড়েমুচড়ে দিতে পারবি। তিন মাত্রার একটা কাগজের বক্সকেও তোরা বাঁকাতে পারবি বা দুমড়েমুচড়ে দিতে পারবি। কিন্তু চারমাত্রার স্থানকালকে আবার বাঁকায় কী করে? এ তো অসম্ভব একটা কাজ। </p> <p>পদার্থবিজ্ঞানে শুধু স্থানকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন কাজ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আবার কাল বা সময়। এই সংযুক্তি পুরো বিষয়টাকে এমনিতেই এতটা জটিল করে তুলেছে যে সাধারণ চারমাত্রা কল্পনা করাও অসম্ভব একটা বিষয়, এর বক্রতা তো আরও পরের ঘটনা। যে জ্যামিতিক কাঠামোর কোনো আকৃতি কোনো মানুষ কোনোদিন দেখে নাই বা উপলব্ধি করে নাই, গাণিতিক যুক্তিই যে তত্ত্বের একমাত্র সম্বল, সেই তত্ত্বের মূল ভাব বোঝানোর জন্য উপমা ছাড়া কোনো গতি নেই। দুইমাত্রার একটি চাদরের চার কোণা চারজন ধরে রেখে চাদরের মাঝ বরাবর একটা ভারি জিনিস রেখে দিলে সেখানটায় একটা গর্তের মতো তৈরি হবে। </p> <p>চারমাত্রার বক্রতাকে বোঝানোর জন্য এরকম একটা উপমা ব্যবহারের বেশ প্রচলন আছে। দুই মাত্রা আর চারমাত্রার মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক। কিন্তু আইনস্টাইনের বুদ্ধিদীপ্ত এই কাজকে ভিজ্যুয়ালাইজ করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের হাতে যে এর থেকে ভালো কোনো অপশনও নেই।’</p> <p>‘ওয়ার্মহোলের নাম তো তোরা শুনেছিস?’ আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন সুবিদ হাসান।</p> <p>পুরো ক্লাসে মাত্র দুইজন হাত তুললো। বাকিরা জানার জন্য সুবিদ হাসানকে বলতে অনুরোধ করল। সুবিদ স্যার সময় নষ্ট না করে সরাসরি আলোচনায় চলে গেলেন।</p> <p>‘ওয়ার্মহোল হচ্ছে মহাকাশের গভীরে এক ধরনের টানেল বা সুড়ঙ্গ। এই টানেলটি মহাবিশ্বের দূরবর্তী দুটি স্থানকে যুক্ত করে। এটাও গাণিতিক যুক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি হাইপোথেসিস। ওয়ার্মহোল আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি বা এর কোনো সন্ধানও পাওয়া যায়নি। এই টানেলটির জন্য উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কীট বা পোকায় খাওয়া একটি আপেলকে। পোকা আপেলটির একদিক দিয়ে খেয়ে ভেতর দিয়ে টানেল তৈরি করে আপেলের বিপরীত দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। তাহলে এখানে আপেলটাকে মহাবিশ্ব বলে ধরে নিয়ে এর ভেতর দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ কল্পনা করা হয়েছে। পোকাটি যদি সুড়ঙ্গ ধরে না গিয়ে আপেলের বাইরের গা ধরে যেত, তবে আপেলের বিপরীতদিকে যেতে পোকাটির অনেক বেশি সময় লাগত। আপেলের ভেতর দিয়ে তৈরি হওয়া সুড়ঙ্গ দিয়ে পোকাটি অনেক কম সময়ে আপেলের বিপরীতদিকে যেতে পারে। ওয়ার্মহোলকে তাই অসীম মহাবিশ্বের শর্টকাট রাস্তা বলা হয়। কীট ইংরেজি হচ্ছে ওয়ার্ম। এমন ধারণা থেকেই মূলত ‘ওয়ার্মহোল’ বা কীটগহ্বর নামটি এসেছে।’</p> <p>লেখক: চিকিৎসক ও বিজ্ঞান লেখক<br />  </p>