<p>শুক্রবার সন্ধ্যা। কর্মহীন এক দিনের শেষে সুবিদ হাসানের বাড়ির বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন সুবিদ হাসান ও তাঁর সহকর্মী, শিক্ষক রুহুল আমীন। বসন্তের শুরুর দিক; আবহাওয়া পরিষ্কার, হালকা ঝিরঝিরে বাতাসের একটা আবেশ ছড়িয়ে আছে বাড়িটাকে ঘিরে। স্কুল বন্ধ থাকলেও বলতে গেলে প্রতি শুক্রবারই দিন শেষে সুবিদ হাসানের বাড়ির বারান্দায় স্কুলেরই কোনো না কোনো এক শিক্ষকের সাথে আড্ডা বসে। সারা দিন বই পড়ে, শুয়ে-বসে থেকে যখন আর ভালো লাগে না তখন একটু বাইরে গিয়ে গায়ে হাওয়া-বাতাস লাগানোর একটা অভ্যাস অনেকেরই আছে। আসলে টানা ছয় দিন কাজের চাপে অভ্যস্ত হওয়া শরীর একটু বিশ্রামেই যেন বিদ্রোহ করে বসে।</p> <p>এই দিন বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে সুবিদ হাসান বাড়িতেই কাটিয়ে দেন সারাটা দিন। তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার মানুষ বলতে তাঁর স্কুলের সহকর্মীরাই আছে। দেখা যায় সন্ধ্যা হওয়ার পরপরই কেউ না কেউ এসে ঠিক হাজির হয়ে যায়। সংখ্যাটা দুইয়ের অধিক হলেই জমে ওঠে আড্ডা। আজ অবশ্য সুবিদ হাসানের বারান্দায় রুহুল আমীন ছাড়া অন্য কোনো সহকর্মীকে দেখা গেল না। সুবিদ হাসান সব সময়ই রাজনৈতিক আলোচনা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু দুই বা ততোধিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একত্রে বসে কিছুটা সময় কাটাবে, আর সেখানে রাজনৈতিক আলোচনা হবে না, সেটা অন্তত আমাদের এই উপমহাদেশের জন্য একেবারেই বেমানান। সুবিদ হাসান রাজনৈতিক আলোচনা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন, কারণ তিনি জানেন যে এ ধরনের আলোচনা অনেক সময়ই আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। আর যে আলোচনায় আবেগ এসে হানা দেয়, সেই আলোচনা অধিকাংশ সময় নোংরা বাগবিতণ্ডা দিয়ে শেষ হয়। এর ফলাফলও হয় সুদূরপ্রসারী। সহকর্মীদের মধ্যে একটা শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেটা যেন না হয় তারই একটা চেষ্টা থাকে সুবিদ হাসানের আচরণে। তাই তিনি প্রসঙ্গ পালটাতে খুব বেশি দেরি করেন না। </p> <p>সেদিনও সন্ধ্যায় কী একটা কথার সূত্র ধরে রুহুল আমীন একটা রাজনৈতিক মন্তব্য করে বসলেন। সুবিদ হাসান অনেকটা না শোনার ভান করেই রুহুল আমীনকে তাঁর বাঁ হাতের মধ্যমা আঙুলে শোভা পাওয়া পাথরের আংটি দেখিয়ে সেটার কাজ জানতে চাইলেন।</p> <p>‘তো, রুহুল মিয়া, আপনার আঙুলের আংটি কোনো কাজ-টাজ করল? মানে বলতে চাচ্ছি, যে উদ্দেশ্যে আপনারা এইসব আঙটি হাতের আঙুলে পরে থাকেন সেইসব উদ্দেশ্য কি আসলেই সফল হয় কখনো?’ কথাটা বলে সুবিদ হাসান রুহুল আমীনের দিকে চেয়ে রইলেন বহুবার শোনা সেই উত্তরের অপেক্ষায়। শুনলেনও সেটা।</p> <p>রুহুল আমীন বলল, ‘উপকার কিছু হয় বলেই তো মানুষ যুগ যুগ ধরে এগুলো ব্যবহার করে আসছে, তাই না? তা ছাড়া আপনি তো বিজ্ঞানের ইতিহাস খুব ভালো করেই জানেন। একটা সময় জ্যোতিষবিদ্যা আর জোতির্বিদ্যার কাজকারবার সব আকাশ পর্যবেক্ষকরাই করত। পরে তো জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞানের থেকে আলাদা হয়ে গেল; জ্যোতির্বিদ্যা হয়ে গেল বিজ্ঞানের অংশ। কিন্তু কিছু মানুষ তখনো জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা চালিয়ে গেলেন। সবচেয়ে প্রাচীনতম বিদ্যা তো এই জ্যোতির্বিদ্যাই, তাই না। সুতরাং কিছু না কিছু তো আছেই এতে। এত বছরের সাধনায় তাঁরা কি আর বেগার খেটেই সারা হলেন! আমার তো মনে হয় না। একমাত্র আপনাদের মতো বিজ্ঞানপ্রেমীরাই এসবের প্রতি বিশ্বাস থেকে মানুষের মন উঠিয়ে নিচ্ছেন।’</p> <p>‘বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনার ধারণা খুব একটা পাকাপোক্ত না, বোঝা যায় রুহুল মিয়া।’ বললেন সুবিদ হাসান। </p> <p>সঙ্গে আরো যোগ করলেন, ‘যে জিনিসের শক্ত কোনো ভিত্তি নেই, যে জিনিসের পক্ষে কোনো প্রমাণ কেউ কোনো দিন দিতে পারেনি, যে জিনিসে প্রয়োগ করা যুক্তি বারবার হতাশার জন্ম দেয়, সেই জিনিসের প্রতি আপনাদের কীভাবে এত বিশ্বাস আসে তা আমার মাথায় ঢোকে না।’</p> <p>চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে রুহুল আমীন বলল, ‘এ কথা তো স্বীকার করবেন, জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারেনি। ফলে সব কিছু বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা না করাই ভালো।’</p> <p>সুবিদ হাসান কিছুটা অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তাই বলে আপনি আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বলেন যে গ্রহ-নক্ষত্র মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে? এটা তো বোঝাই যায় যে মানুষ যখন এসব বিশ্বাস করত তখন গ্রহ-নক্ষত্র আসলে কী জিনিস সেটাই তাঁরা ঠিকমতো বুঝতে পারত না। আর এই ‘না বোঝা’ থেকে মানুষ কত কী-ই তো ভেবে বসল। তা ছাড়া আজ হাজার হাজার বছর পর বিজ্ঞান সেইসব গ্রহ-নক্ষত্রের ভেতরের সব খবরাখবর এনে দিলেও কিছু মানুষ সেই মান্ধাতা আমলের জ্ঞানকেই আঁকড়ে ধরে বসে আছে। বিজ্ঞান সম্পর্কে খুব ভালো জানাশোনা থাকলে বুঝতে পারতেন যে কী এক ভুলের মধ্যে আছেন আপনারা।’</p> <p>‘আমি জানি সেটা।’ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল রুহুল আমীন। ‘কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না যে বিজ্ঞান সব কিছুর উত্তর জানে।’</p> <p>‘সেটাও আমি বলছি না।’ জবাবে সুবিদ হাসান বললেন।</p> <p>‘আমি নিজেও স্বীকার করি যে বিজ্ঞান এখনো অনেক কিছুর উত্তর বের করতে পারেনি। বিজ্ঞানীরাও কিন্তু বসে নেই। প্রতিদিনই বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হচ্ছে। আজ থেকে কয়েকশত বছর আগেও মানুষ মনে করত পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্র। এটা যে ভুল সেটা কিন্তু বিজ্ঞানই প্রথম প্রমাণ করে দেখিয়েছে। আপনারাও সেটা মেনে নিয়েছেন। আসলে সবাই মেনে নিয়েছি, কারণ বিজ্ঞানের কাজ করার পদ্ধতিতে এমন কিছু একটা আছে, যা সবার আস্থা অর্জন করে নিয়েছে। কোনো ভুল ধারণাই কিন্তু রাতারাতি ভুল প্রমাণিত হয়নি। বহু বছর সময় লেগেছে একটা যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে। আর সেগুলো যুক্তিসম্মত হয়েছে এ জন্য যে সেগুলো বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই<br /> করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুতরাং আপনি যেসব বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা বের করতে বিজ্ঞানকে অপারগ বলছেন সেগুলো যে অদূর ভবিষ্যতে বের করে ফেলা হবে সেটা বিজ্ঞানী মাত্রই জানেন। একটু সময় লাগছে আর কি। হয়তো সেই পর্যায়ে উঁকি দেওয়ার মতো প্রযুক্তি আমাদের হাতে এখনো আসেনি। প্রযুক্তির আরো উন্নতির মাধ্যমে সেগুলো একদিন বের করে ফেলা কঠিন কিছু হবে না। বুদ্ধিমানরা সব সময়ই বিজ্ঞানকে অন্য সব কিছুর ওপরে স্থান দিয়ে থাকেন। বিজ্ঞান কেন অপ্রমাণিত অযৌক্তিক বিশ্বাসের থেকে উত্তম সেটা বুঝবেন যখন আপনি জানবেন যে বিজ্ঞান আসলে কিভাবে কাজ করে।’</p> <p>এটা বলে সুবিদ হাসান ঘরে গিয়ে আরো দুই কাপ চা নিয়ে এলেন। ‘আপনার হাতে সময় থাকলে এ বিষয়ে কিছু কথা বলতে পারি।’</p> <p>রুহুল আমীন আগ্রহী হয়ে উঠলেন বোঝা গেল। সুবিদ হাসানের সাথে অনেকেরই অনেক বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও সবাই সুবিদ হাসানের সহজ-সরল ভাষায় বিজ্ঞানকে তুলে ধরার ক্ষমতাকে সম্মান করে। ফলে সুবিদ হাসানের জ্ঞানগর্ভ কথা শোনার একটা তাড়না কাজ করে সবার মধ্যে। রুহুল আমীনও এর ব্যতিক্রম না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রুহুল আমীন একটু আরাম করে বসলেন। সুবিদ হাসান বুঝলেন যে রুহুল সাহেব তাঁর (সুবিদ হাসানের) কথাগুলো শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। সুবিদ হাসান চেয়ারে হেলান দিয়ে চায়ের কাপে ছোট একটা চুমুক দিয়ে তাঁর কথা শুরু করলেন।</p> <p>‘প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা চলছে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। বিজ্ঞানচিন্তা বা বিজ্ঞান-ভাবনা বহুদিনের হলেও বিজ্ঞান বলতে আজ আমরা যা বুঝি তার বয়স কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। গবেষণার ক্ষেত্রে গ্যালিলিও যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন সেটাকেই আজ আমরা বিজ্ঞান বলি। সেই দিক বিবেচনায় গ্যালেলিও পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানীও বটে। একটা সময় ছিল যখন প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিশুদ্ধ চিন্তার আশ্রয় নেয়া হতো। গত কয়েকশত বছরের সুক্ষ পর্যবেক্ষণে এসব চিন্তার বেশির ভাগই বাতিল হয়ে গেছে। বিজ্ঞানকে সংশয়মুক্ত রাখতে গ্যালেলিও’র কার্যপদ্ধতি আজ সর্বজনস্বীকৃত। আজকের কোনো বৈজ্ঞানিক মতবাদই এই পদ্ধতিতন্ত্রের বাইরে গিয়ে ‘তত্ত্ব' হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে না। বিজ্ঞানের আওতাধীন কোনো একটি বিষয় নিয়ে গবেষণাকালে একজন বিজ্ঞানীকে অবশ্যই কতগুলো নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটা এমন এক আইন, যে আইন প্রতিটা গবেষক মানতে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মহাবিশ্বের কোনো একটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হলো যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদের অজানা, অথবা জানা থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। সেক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের হাইপোথেসিস বা অনুকল্প পেশ করতে পারেন। যোগ্যতাসম্পন্ন সব<br /> গবেষকই এই স্বাধীনতা ভোগ করেন। তবে এই অনুকল্পগুলো দেওয়া হবে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের জানা নির্ধারিত আইনের ভিত্তিতে। এখন প্রত্যেক গবেষক তাঁর অনুকল্প মোতাবেক আরো কিছু ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যাচাই করে দেখবে এর সাথে জড়িত পরীক্ষণ পদার্থবিদগণ। যদি সেই পরীক্ষাগুলো অনুকল্পটিকে অযোগ্য বলে প্রমাণ করে, তবে সুযোগ থাকে পরিমার্জন করে সেটাকে আবার নতুনভাবে গড়ে তোলার। তবে সেটাকেও তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে পরবর্তী সব পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়ে আসতে হবে। একজন বিজ্ঞানীর খ্যাতি, ক্ষমতা, অর্থ-বৈভব, মেধা ইত্যাদি কোনো কিছুই একটি অনুকল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই অনুকল্পটি পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে। গাণিতিক যুক্তি ও অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইতিবাচক ফলাফল একটি অনুকল্পকে তত্ত্বের মর্যাদা দান করে। তত্ত্বের মর্যাদা পেলেই কিন্তু একটি তত্ত্বকে সন্দেহের তালিকা থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয় না। পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ চলতে থাকে বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী। সেক্ষেত্রে একটি তত্ত্ব যদি কয়েক শতাব্দী পর সম্পূর্ণ বা আংশিক ভুল প্রমাণিত হয়, তবে সেই তত্ত্বটিকে<br /> ভেঙেচুরে পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করা হয়। আর যদি সেটা সম্ভব না হয় তবে সম্পূর্ণ নতুন একটি তত্ত্বের প্রয়োজন হয়। সব তত্ত্বকেই কি চিরকালের জন্য ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়? এর উত্তর নির্ভর করে তত্ত্বের প্রয়োগক্ষেত্রের ওপর। এমন অনেক তত্ত্ব থাকে যেগুলো একটি নির্দিষ্ট সীমায় যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমাণিত হলেও সেই সীমার বাইরে গিয়ে আর কাজ করতে পারে না। যেমন- নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের তুলনায় আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের প্রয়োগক্ষেত্র বেশি। তাই বলে প্রকৃতি কঠোরভাবে কেবলমাত্র আইনস্টাইনের তত্ত্ব মানতে বাধ্য নয়। গ্রহগতির ব্যাখ্যা, রকেট উৎক্ষেপণ বা স্যাটেলাইট স্থাপন, স্পেসে মহাকাশযান প্রেরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোতে আমরা এখনও নিউটনের মহাকর্ষীয় নীতি ব্যবহার করি। আবার যখন যুগ্ম পালসার, কৃষ্ণ গহ্বর, মহাবিশ্বের প্রসারণ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিয়ে কথা বলি তখন আইনস্টাইনের<br /> তত্ত্বের সাহায্য নিতে হয়। কেবল একটি সীমার বাইরে গিয়ে এই মহাজগৎকে ব্যখ্যা করলেই সেই তত্ত্বকে সার্থক বলে ধরা যায় না। নতুন তত্ত্বটিকে একটা পর্যায়ে গিয়ে আগের তত্ত্বটির সীমানায় থাকা সব কিছুকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতাও থাকতে হয়। প্রয়োগক্ষেত্র বিস্তৃত হওয়ায় নতুন তত্ত্বটির গ্রহণযোগ্যতা অন্যটির তুলনায় বেশি থাকে। তবে এর অর্থ এই নয় যে আইনস্টাইনের তত্ত্বটি কালোত্তীর্ণ তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে।</p> <p>সুদূর ভবিষ্যতে এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার হওয়া সম্ভব বা এমন কোনো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব যার দ্বারা আজকের তথ্য উপাত্তগুলোকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা যায়। সেক্ষেত্রে আবার নতুন ফলাফলকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়োজন হতে পারে নতুন তত্ত্বের। অনেক সময় ভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি পরীক্ষায় এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত ফলাফল বেরিয়ে আসে যেটা সুপ্রতিষ্ঠিত একটি তত্ত্বের ভিতকে নাড়িয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালে সার্ন দ্বারা পরিচালিত একটি পরীক্ষায় নিউট্রিনোর বেগ পাওয়া গেল আলোর বেগের চেয়ে বেশি। এই ফল বিজ্ঞানীসমাজে অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছিল, কেননা এটা সঠিক হলে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বইগুলোকে হয়তো আবার নতুন করে লিখতে হতো। তবে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে তত্ত্বের ভেতরে অপ্রয়োজনীয় অংশ ঢুকিয়ে তত্ত্বের সরলতা নষ্ট করাকে অনুৎসাহিত করে। বিষয়টিকে ‘অক্কামের ক্ষুর’-এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়।’</p> <p>রুহুল আমীন মনোযোগের সঙ্গে সুবিদ হাসানের কথাগুলো শুনছিলেন। ঠিক এখানটাতে এসে রুহুল আমীন কিছুটা অনিশ্চিতের ভঙ্গিতে বলে ফেললেন, ‘স্যার, যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি। আপনি তো বিজ্ঞানের মানুষ; তাছাড়া অনেক পড়াশোনাও আছে। আপনি অনেক কিছু যত সহজে বোঝেন, আমরা তত সহজে বুঝি না সেগুলো। আপনি এ পর্যন্ত অনেকগুলো বিষয় উল্লেখ করেছেন যেগুলো সম্পর্কে আমি খুব ভালো না জানলেও এখান-সেখান থেকে টুকটাক শুনেছি। কিন্তু এই ‘অক্কামের ক্ষুর’ জিনিসটা আবার কী? নাম শুনে কেমন দাড়িগোঁফ কামানোর ক্ষুরের মতো মনে হচ্ছে।’</p> <p>‘অক্কামের ক্ষুরের মূল কথা হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যতা পরিহার করো, বা যথাসম্ভব সরল রাখার চেষ্টা করো। ভাবনাটা প্রথম যার মাথা থেকে বের হয়েছিল তাঁর নাম উইলিয়াম অক্কাম, একজন ইংরেজ দার্শনিক।’</p> <p>‘বিজ্ঞানের মধ্যে আবার দর্শন এলো কোত্থেকে? আমি তো জানি দর্শন বিজ্ঞান থেকে আলাদা হয়ে গেছে।’</p> <p>‘হ্যাঁ, আলাদা হয়েছে, কিন্তু এটা একটা অনুসিদ্ধান্ত; মানে এই বক্তব্যটাকে সঠিক হওয়ার জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এটা এমনিতেই বোঝা যায়। একটু লক্ষ করলে দেখবেন যে গণিতের অনেক কিছুই কিন্তু প্রথমে অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। গণিত যে আমাদের জীবনে কতটা সুন্দরভাবে কাজ করে সে তো আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাই। তাছাড়া আমার আলোচনায় একটু পরেই গণিত আসবে। তখন আরো ভালো বুঝতে পারবেন।’ বলেই আবার কোনো প্রকার বিরতি না দিয়ে শুরু করলেন।</p> <p>‘একাধিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে কোনোটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটা আমরা দেখেছি। সব তত্ত্ব কিন্তু একই কথা বলে না। যেমন- পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। এর কারণ কী? নিউটন বললেন মহাকর্ষ নামক অদৃশ্য একটা বল। আইনস্টাইন বললেন স্থান-কাল বক্রতা। এখন কেউ একজন বলল, পৃথিবী ও সূর্য কৃষ্ণ-পদার্থে সৃষ্ট অদৃশ্য একটা রশি দ্বারা যুক্ত এবং মহাকর্ষ বলটা আদান-প্রদান হয় এই রশির মাধ্যমে। যেখানে শুধুমাত্র বল দ্বারা পুরো বিষয়টিকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে, সেখানে রশির চিন্তা<br /> অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যতাকেই নির্দেশ করে। গ্রহণযোগ্যতার বিচারে দেখবেন অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যতা-বর্জিত তত্ত্বগুলোই সবসময় এগিয়ে থাকে।’</p> <p>তিনি আরো বললেন, ‘বর্তমান পদার্থবিজ্ঞান বা মহাকাশবিজ্ঞান পুরোপুরি গণিতনির্ভর। এই গণিতনির্ভরতা বিষয়টিকে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলে। কেননা গণিতের মূল সিদ্ধান্তগুলো সব স্বপ্রমাণিত। অর্থাৎ এগুলোকে অনায়াসে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। যেমন- দ্বিমাত্রিক তলে ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি বা∫lnxdx=xlnxx+C ইত্যাদি গাণিতিক সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত সত্য। এখন কোনো একটি তাত্ত্বিক গবেষণায় যদি কেউ এই সূত্র ব্যবহার করে এবং পুরো গবেষণার গাণিতিক প্রক্রিয়ায় এ ধরনের গাণিতিক সূত্র ও নিয়মগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে তবে সেই গবেষণাকর্মটির গ্রহণযোগ্যতাও বহুগুণে বেড়ে যায়। প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে তাই গণিতের ব্যবহার সর্বত্র। তেমনই বিজ্ঞান গবেষণায় পদার্থবিজ্ঞানের স্বতঃসিদ্ধ সূত্র বা সমীকরণগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে এই সূত্রগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গৃহীত হতে হলে অবশ্যই বিজ্ঞানের পদ্ধতিতন্ত্রের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় গবেষণা ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে। প্রকৃতির ব্যাখ্যা দু’ভাবে দেওয়া যায়- নিজের যৌক্তিক চিন্তাভাবনা বা কাল্পনিক পরীক্ষাগুলোকে গণিতের ছাঁচে ফেলে, অথবা পরীক্ষার ফলকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে গণিতের সাহায্য নিয়ে। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রথম এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল।’</p> <p>‘এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো যদি নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেয়া না হয় তবে বিজ্ঞানে বিশ্বাস বা সত্যের জায়গাটুকু কোথায়। প্রথমত বলতে হয় বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বিজ্ঞান চায় প্রমাণ। কিন্তু আমরা বলেছি কোনো এক কালে প্রাপ্ত প্রমাণও চিরন্তন নয়। ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি তথ্য-উপাত্তকে ভিন্নভাবে প্রদর্শন করতে পারে। ফলে বলা যায়, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে পরম সত্য বলে আসলে কিছু নেই। প্রকৃতিকে জানা বা বোঝার জন্য সবচেয়ে সেরা ব্যাখ্যাটাকেই ‘তত্ত্ব’ নাম দিয়ে গ্রহণ করা হয়। প্রকৃতি আমাদের তত্ত্বের পরোয়া করে না। আমরাই বরং প্রকৃতিকে বোঝার জন্য তত্ত্ব বানাই। সুতরাং সেই তত্ত্বকে শাশ্বত বলে ধরে নেয়াটা ঠিক হবে না। তবে একথা মানতেই হবে যে সত্যকে খুঁজে বের করাই বিজ্ঞানের কাজ। আর এই অনুসন্ধানকার্য সত্যের পথেই থাকে, কেননা প্রতিটি তত্ত্বকে কঠিন ও অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেয়া হয়। তারপরও একজন বিজ্ঞানী কখনই বলতে পারেন না যে আমার তত্ত্ব চিরস্থায়ী, নির্ভুল ও অপরিবর্তনীয়।’</p> <p>সুবিদ হাসান আড়মোড়া দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। টানা এতটা সময় বসে থেকে শরীরটা যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। এটা যে সুবিদ হাসানের দীর্ঘ আলোচনা শেষ হওয়ার ইঙ্গিত সেটা রুহুল আমীন খুব ভালো করেই জানেন। তা ছাড়া রাতের খাবার খাওয়ার সময়ও হয়ে এলো বলে।</p> <p>রুহুল আমীন বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে একটা পরিবর্তন এসেছে সেটা তিনি যেতে যেতে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারলেন। পরের দিন সরকারি ছুটি থাকায় স্কুল বন্ধ ছিল। সেদিন সন্ধ্যার আলোচনার প্রভাব সুবিদ হাসান বুঝতে পারলেন রবিবার। শিক্ষক রুমে ঢুকেই রুহুল আমীনকে পেয়ে গেলেন, হাতে ক্ষমতাধর সেই আংটিটা আর নেই। সুবিদ হাসান মনে মনে চিন্তা করলেন যে এভাবেই যদি আমরা সমাজটাকে পরিবর্তন করতে পারতাম তবে একদিন হয়তো আমরা বিজ্ঞাননির্ভর একটা সমাজব্যবস্থা পেয়ে যেতেও পারি।<br />  </p>