<p>সময়টা ১৯১৯ সাল। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে একটি চিঠি এসেছে। চিঠির সাথে রয়েছে বেশ কিছু জটিল সমীকরণ। চিঠিটি লিখেছেন থিওডোর কালুৎজা নামে একজন গণিতবিদ। বিজ্ঞানী সমাজে তিনি তেমন পরিচিত কেউ নন। অথচ তাঁর সমীকরণে চোখ বুলিয়ে আইনস্টাইন একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। খুবই চমকপ্রদ একটি ধারণার সন্ধান পেলেন তিনি। </p> <p>বিজ্ঞানী হিসেবে আইনস্টাইনের খ্যাতি তখন বিশ্বজোড়া। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি তাঁর তত্ত্বে স্থান এবং কালকে এক সম্পূর্ণ নুতন দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও স্থান এবং কালকে আমরা আলাদা মনে করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বে স্থান এবং কাল একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। স্থান এবং কালের যৌথ বুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে। </p> <p>আইনস্টাইন বললেন, বস্তুর উপস্থিতির জন্য স্থান-কালের বুননের মধ্যে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কৃত মহাকর্ষ বলকে তিনি এক সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে, নিউটন বলেছিলেন, যে বস্তুর ভর যত বেশি তার মহাকর্ষ বলও তত প্রবল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে, আইনস্টাইন একটি সম্পূর্ণ নতুন কথা শোনালেন। তিনি বললেন, বস্তুর ভরের জন্য তার চারপাশে স্থান-কালের বুননের মধ্যে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়, সেটিই হলো মহাকর্ষ বলের উৎস। যে বস্তুর ভর যত বেশি তার চারপাশে বক্রতার পরিমাণও তত বেশি এবং সেজন্যই তার মহাকর্ষ বলও তত বেশি। এরকম যুগান্তকারী ধারণা আইনস্টাইনের আগে আর কারো মাথায় আসেনি। </p> <p>মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন কালুৎজার চিঠিটি পড়ে খুব অবাক হলেন। তিনি দেখলেন, কালুৎজা সাধারণ আপেক্ষিকতার ধারণাটিকে মহাকর্ষ ছাড়িয়ে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কালুৎজা তাঁর সমীকরণে অতিরিক্ত আরেকটি মাত্রার আশ্রয় নিয়েছেন। এই অতিরিক্ত মাত্রার সাহায্যে তিনি ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বকীয় বলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মোদ্দা কথা হলো, এর মাধ্যমে তিনি মহাকর্ষ ও তড়িৎ চুম্বকীয় বল, এ দুটি প্রাকৃতিক বলের সমন্বয় করে ফেলেছেন। কালুৎজার সমীকরণে আইনস্টাইন কোন ভুল দেখতে পেলেন না। কিন্তু ঐ অতিরিক্ত মাত্রাটির বৈশিষ্ট্যটি কি সেটা কালুৎজা ব্যাখ্যা করেননি। আইনস্টাইনও সেটার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। পরবর্তীতে অস্কার ক্লাইন নামে একজন বিজ্ঞানী এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই অতিরিক্ত মাত্রাটি এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে প্রকৃতিতে আমরা একে দেখতে পাই না। এটাই হলো স্ট্রিং থিওরির গোড়ার কথা। </p> <p>আইনস্টাইনের পরবর্তী যুগের বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর ভিত্তি করে পদার্থের মৌলিক গঠনের একটি গ্রহণযোগ্য মডেল দাঁড় করিয়েছেন। এর নাম, বস্তুকণার স্ট্যান্ডার্ড মডেল। তাঁরা বলেছেন, মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থই মূলত দুই ধরনের বস্তুকণা দিয়ে গঠিত, এদেরকে বলে কোয়ার্ক এবং লেপ্টন। কিন্তু স্ট্রিং থিওরির প্রবক্তা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেছেন, এটাই শেষ কথা নয়। কোয়ার্ক এবং লেপ্টনের ভেতরে রয়েছে এক রহস্যময় জগত। যে জগতে রয়েছে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একমাত্রিক কম্পমান স্ট্রিং। পরমাণুর কেন্দ্রের নিউক্লিয়াসের চেয়েও এরা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গুণ ছোট। মূলত এরাই হলো পদার্থের ক্ষুদ্রতম মৌলিক একক। এদের দৈর্ঘ্য হলো, ১.৬ x ১০^-৩৫ মিটার। এই দৈর্ঘ্যকে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক লেংথ। এই দৈর্ঘ্যটির নিচে বস্তুকণার স্বরূপ নির্ধারণ করা যায় না। বস্তুকণার এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগত চলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুসারে। পদার্থ বিজ্ঞানের অন্যান্য নিয়ম এখানে খাটে না। </p> <p>তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে, গিটারের তারের মতই এই স্ট্রিং গুলোর কম্পনের ফলে এদের ভেতর এক ধরনের অনুনাদ বা রেজোন্যান্সের সৃষ্টি হয়। এই অনুনাদের বহিঃপ্রকাশকে আমরা দেখি বস্তুকণা হিসেবে। স্ট্রিংয়ের কম্পনের তারতম্যের ফলে বস্তুকণার বৈশিষ্ট্যও বিভিন্ন ধরনের হয়। স্ট্রিংয়ের ভেতরে এক ধরনের কম্পনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে লেপ্টন, আবার অন্য ধরনের কম্পন থেকে উদ্ভব হয়েছে কোয়ার্ক। অর্থাৎ লেপ্টন এবং কোয়ার্কের ভৌত ধর্ম আলাদা হলেও এদের মৌলিক গঠন হলো অভিন্ন। </p> <p>স্ট্রিংয়ের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা উচ্চ মাত্রার গাণিতিক সমীকরণের সাহায্য নিয়েছেন। এসব সমীকরণে তারা দেখিয়েছেন, এগারোটি ডাইমেনশন বা মাত্রা রয়েছে মহাবিশ্বে। তবে এসব উচ্চতর মাত্রা গুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং কোঁকড়ানো ও প্যাঁচানো অবস্থায় থাকে, সেজন্য আমরা এদের কখনোই দেখতে পাই না। এদেরকে বলা হয়, হাইপার ডাইমেনশন। এই উচ্চতর মাত্রাগুলো রয়েছে আমাদের দৃষ্টির সম্পূর্ণ অগোচরে। </p> <p>অদৃশ্য উচ্চতর মাত্রার ব্যাপারটি যতই অদ্ভুত মনে হোক না কেন, স্ট্রিং থিওরির বিশেষত্ব হলো, এটিই পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র তত্ত্ব যা দিয়ে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুকণার চরিত্র ব্যাখ্যা করা যায় এবং মহাকর্ষ সহ প্রকৃতিতে বিদ্যমান চারটি মৌলিক বলকে একীভূত করা যায়। স্ট্রিং থিওরিতে একটি কোয়ান্টাম কণার কথা বলা হয়েছে, যার ভর শুন্য কিন্তু স্পিন হলো দুই, অর্থাৎ ফোটনের দ্বিগুণ। এই ভর শূন্য কণাটির নাম হলো, গ্র্যাভিটন। আলোর ফোটন কণার মতই এটিও একটি বল বহনকারী কণা, অর্থাৎ বোসন। স্ট্রিং থিওরি মতে, গ্র্যাভিটন কণাই হলো মহাকর্ষ বলের উৎস। </p> <p>স্ট্রিং থিওরিতে দুই ধরনের স্ট্রিংয়ের ধারণা দেয়া হয়েছে, ক্লোজ স্ট্রিং এবং ওপেন স্ট্রিং। ক্লোজ স্ট্রিং গুলো স্থান-কালের মাঝে মুক্তভাবে বিচরন করতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ক্লোজ স্ট্রিং গুলো থেকেই গ্রাভিটন কণার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, ওপেন স্ট্রিং গুলো স্থান-কালের মাঝে মুক্তভাবে পরিভ্রমণ করতে পারে না। বিজ্ঞানীদের মতে, ওপেন স্ট্রিং গুলো মহাকর্ষ বল বাদে, অন্য তিনটি প্রাকৃতিক বলের উৎস। </p> <p>মজার ব্যাপার হলো, বস্তুকণার আচরণের ব্যাখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি স্ট্রিং থিওরী স্থান-কালের গঠনের ব্যাখ্যাও দিতে পারে। স্ট্রিং থিওরী গাণিতিকভাবেও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সমীকরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এজন্য স্ট্রিং থিওরিকে নিয়ে এর প্রবক্তা বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত আশাবাদী। </p> <p>স্ট্রিং থিওরীর স্বপক্ষে অবশ্য কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। এটি এখনো তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের গাণিতিক সমীকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে স্ট্রিং থিওরির বিশেষত্ব হলো, এটাই একমাত্র তত্ত্ব যা দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের দুটো প্রধান স্তম্ভ, সাধারন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মধ্যে একটি সমন্বয় করা যায়। সেজন্যই স্ট্রিং থিওরিকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত আশাবাদী। অনেকে মনে করেন, এটি হলো, "থিওরি অফ এভরিথিং" বা সকল কিছুর তত্ত্ব। <br /> স্ট্রিং থিওরীর একজন অন্যতম গবেষক হলেন, মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক মিচিও কাকু। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের একজন সফল লেখক হিসেবেও তাঁর বিশেষ সুনাম রয়েছে। তিনি মনে করেন, স্ট্রিংয়ের সম্মিলিত ঐকতানে সুর ও সংগীতের যে মূর্ছনা সৃষ্টি হয়েছে সেটাই বিমুর্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে পদার্থের সকল অণু-পরমাণুতে। তাঁর মতে, পুরো মহাবিশ্বটাই যেন কম্পমান স্ট্রিংয়ের একটি বিশাল সিম্ফোনি। </p> <p>কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের সকল তত্ত্বকেই পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হয়। এটি না হলে কোন তত্ত্বই সর্বজন স্বীকৃত হয়না। স্ট্রিং থিওরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর স্বপক্ষে পরীক্ষামূলক অথবা পর্যবেক্ষণগত কোন প্রমাণ নেই। স্ট্রিংয়ের আকৃতি এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে বর্তমান যুগের অতি উচ্চশক্তির পারমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষায়ও স্ট্রিংয়ের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্ট্রিংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার মতো শক্তিশালী পার্টিকেল এক্সেলেটর এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে কিনা সেই নিশ্চয়তাও বর্তমানে নেই। সেজন্য অনেক বিজ্ঞানী একে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের চেয়ে দর্শন হিসেবেই বিবেচনা করতে চান। এছাড়া স্ট্রিং থিওরিতে প্রস্তাবিত উচ্চতর মাত্রা নিয়েও অনেক বিজ্ঞানীর মনে সংশয় রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের সীমাবদ্ধতার জন্য স্ট্রিং থিওরিকে প্রমাণ করা হবে দুঃসাধ্য।<br />  </p>