<p>ইংরেজি নাম রেড জায়ান্ট। বাংলায় লোহিত দানব সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? যেসব নক্ষত্র বয়েসে প্রবীণ, তারা কোন এক সময় স্ফীত হতে থাকে। ফলে এক সময় তাদের আয়তন বাড়তে শুরু করে অস্বাভাবিক মাত্রায়। এক সময় তাদের আয়তন হয়ে যায় লাল রঙের বিরাট একটা দৈত্যের মতো। এসময় তাদের নক্ষত্রের মতো বৈশিষ্ট্য আর থাকে না। লাল রঙের এই অতিকায় গোলকের নাম রেড জায়ান্ট বা লাল দৈত্য বা লোহিত দানব বা রক্তিম দৈত্য।</p> <p>মহাবিশ্ব সৃষ্টির গোড়ার দিকে পুরো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিল মহাজাগতিক মেঘ। হাইড্রোজেনের মেঘ। সেসব মেঘ মহাকর্ষ বলের আকর্ষণের প্রভাবে প্রথমে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়। ফলে পুঞ্জিভূত হাইড্রোজনের ঘনত্ব এবং তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। একসময় তাপমাত্রা এমন অবস্থায় আসে যখন এর প্রভাবে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পর যুক্ত হতে শুরু করে। এভাবে দুটো হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এভাবে হাইড্রোজেন পুঞ্জীভূত হয়ে তৈরি করে ফেলে বিরাট বিরাট সব নক্ষত্র। নিউক্লিয়ার ফিউশনের ফলে গ্যাস নিউক্লিয়াসগুলো যুক্ত হওয়ার সময় বিরটা পরিমাণ তাপশক্তি নির্গত হয়। এই কারণে হাইড্রোজেনের যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে হাইড্রোজেনের প্রজ্বলনও বলা হয়। মহাজাগতিক গ্যাস সংকুচিত হয়ে আমাদের সূর্যের নক্ষত্র হিসেবে আবির্ভূত হতে হতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন কোটি বছর।</p> <p>একটা নক্ষত্র কতকাল জ্বলবে, তা নির্ভর করে নক্ষত্রের ভেতরকার হাইড্রোজেনের মোট পরিমাণের ওপর। শুধু হাইড্রোজেনই নক্ষত্রের জন্মকালের সঙ্গী, তখন যে নক্ষত্রের ভেতর হাইড্রোজেন যত বেশি, তার ভরও ততো বেশি। তাহলে এক কথায় হিসাবটা দাঁড়াচ্ছে, নক্ষত্রের ভরের ওপর নির্ভর করছে সে কতকাল জ্বলবে। সুর্যের কথাই ধরা যাক, এর বয়স ৪৬০ কোটি বছর। হিসাব বলে, সূর্যের জন্মকালে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন এর ভেতর পুঞ্জিভূত হয়েছিল, স্বভাবিক প্রজ্জ্বলনে তা নিঃশেষ হতে এক হাজার কোটি বছর সময় লাগবে। কোনো নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের তিনগুন হয়, তাহলে সেই নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মাত্র দুই কোটি বছরেই ফুরিয়ে যাবে। কারণ ভর বেশি হলে মহাকর্ষীয় শক্তিও বেড়ে যায়। ফলে কেন্দ্রীয় অঞ্চলের হাইড্রোজেনের ওপর আরো বেশি মাত্রায় চাপ পড়ে। তাই হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসগুলো দ্রুত পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়। সেইসঙ্গে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায় প্রচণ্ডভাবে। সে কারণে হাইড্রোজেনের জ্বলন চলে খুবই দ্রুত তালে।</p> <p>ধরা যাক, একটা বেলুনে বাতাস ভরা হচ্ছে। বাতাসে চাপে বেলুনটা ফুলে উঠতে শুরু করবে। সাধারণ বেলুন সংকুচিত অবস্থায় থাকে। বাতাসের চাপে সেই সংকুচিত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। যতক্ষণ ভেতরে বাতাস থাকে ততক্ষণ বেলুন ফুলে থাকে। বাতাস বের করে নিলে সেটা আবার সংকুচিত হয়ে যায়। ঠিক এমন ঘটনাই ঘটে নক্ষত্রেরও জীবনে।</p> <p>মহাকর্ষ টানে হাইড্রোজেনের মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে সৃষ্টি করে নক্ষত্র। তারমানে হাইড্রোজেন-মঘ নক্ষত্রের সংকুচিত হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। আবার মহাকর্ষী বলের চাপে তার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের গ্যাস প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায় সেই অনুপাতে। শুরু হয় হাইড্রোজেনের জ্বলন বা ফিউশন। ফিউশনের কারে সৃষ্টি হয় আরো শক্তি। বেলুনের বাতাসের মতো সেই শক্তিই নক্ষত্রকে ফুলিয়ে রাখে। এই অবস্থায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেমন নক্ষত্রকে সংকুচিত করার চেষ্টা করে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফিউশনের কারণে উৎপন্ন শক্তি সেই সংকোচেন বাধা দিয়ে ঠিক রাখে নক্ষত্রের স্বাভাবিক আয়তন।</p> <p>এভাবে নিয়মিত জ্বলনের কারণে একসময় নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের হাইড্রোজেন প্রায় ফুরিয়ে আসে। অন্যদিকে হাইড্রোজেন সংযোজিত হয়ে সৃষ্টি করে হিলিয়াম। হাইড্রোজেন ফুরানোর পর নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চল আবার সংকুচিত হতে থাকে। সংকোচনের কারণে তাপমাত্রা বাড়তে। সেই তাপমাত্রার প্রভাবে কেন্দ্রীর অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সম্প্রসারিত হয়। </p> <p>ব্যাপারটা অনেকটা এমন। নক্ষত্রের ভেতরে থাকে কেন্দ্রীয় অঞ্চল; এই কেন্দ্রীয় অঞ্চলের কেন্দ্রে থাকে অবশিষ্ট হাইড্রোজেন আর বাইরে হিলিয়ামের স্তর। প্রচণ্ড সংকোচনের দরুন কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ফলে সেটা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাপের প্রভাবে কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বহিরাবরণটা প্রসারিত হতে থাকে। প্রসারণের পরে তাপমাত্রা অনেকটাই খুঁইয়ে ফেলে নক্ষত্র। তখন এর উজ্ঝলতা অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। তাই ওই নক্ষত্রটাকে আর উজ্ঝল জ্যোতিষ্কের মতো পাওয়া যায় না।</p> <p>কামারের হাপরের তলায় থাকা একটা উত্তপ্ত লোহার কথা চিন্তা করা যাক। লোহা যখন খুব গরম থাকে তখন একরকম দেখায়, তাপমাত্রা কমলে তার চেহারা আবার আরেক রকম। কম তামাত্রার লোহাকে টকটকে লাল রঙের দেখায়। বহিরাবরণ প্রসারিত নক্ষত্রটাকে ঠিক এমনই লাল দেখায়। লাল রংয়ের এই অতিকায় নক্ষত্রটাকেই বলা হয় রেড জায়ান্ট বা লোহিত দানব বা লাল দানব বা রক্তিম দৈত্য।</p> <p>সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস</p>