<p>দেশে ব্যবহৃত বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিক প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।  সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য। </p> <p>মারণঘাতী ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে বাঁচতে অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের জীবনে এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। তবে এর অপব্যবহারের কারণে যে একদিন বিপর্যয় নেমে আসবে —এমন সতর্কবাণীও করে গিয়েছেন অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারক স্বয়ং আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। </p> <p>বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা চিকিৎসায় ব্যবহারের সুবিধার্থে অ্যান্টিবায়োটিককে তিনটি গ্রুপে ভাগ করেছে। অ্যাক্সেস, ওয়াচ ও রিজার্ভ গ্রুপ। </p> <p>কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সাধারণত দক্ষতার ভিত্তিতে ‘অ্যাক্সেস’ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো খেতে বলতে পারেন। এ গ্রুপের ওষুধ সাধারণত সহজলভ্য এবং এদের দাম ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম । সহজেই  জীবাণুরা এ ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে  পারে না। </p> <p>অন্যদিকে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসায় সাধারণত ‘ওয়াচ’ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্যবহৃত হয়। এ ধরণের ওষুধের বিরুদ্ধে সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তুলে জীবাণুরা। তখন আর তাদের মেরে ফেলা সম্ভব হয় না। তাই ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার খুব সতর্কতার সাথে মনিটরিং করা হয়।</p> <p>চিকিৎসার শেষ ভরসাস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয় রিজার্ভ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো। পূর্বের দুই গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারেও যখন জীবাণুকে মারা যায় না, তখন রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে ব্যবহার করা হয়। </p> <p>২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় দেড় বছরে রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ৭২,৬৭০ জন রোগীর ওপর এ গবেষণা চালানো  হয়। এতে দেখা যায় —দেশে অন্তত ৭৫ শতাংশ ইনফেকশন হয় সালমোনেলা টাইফি, ই-কোলাই, ক্লিবশিয়েলা ও সিউডোমোনাস ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। এগুলোর মাধ্যমে টাইফয়েড, ডায়রিয়া, মূত্রনালির সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, সেপসিস প্রভৃতি রোগ হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, এসব ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাক্সেস ও ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক অকেজো হয়ে গেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। </p> <p>অর্থাৎ আমাদের হাতে থাকা তিন ধরনের জীবাণুঘাতী অস্ত্রের মধ্যে দুইটি গ্রুপের অস্ত্র প্রায় পুরোটাই অক্ষম হয়ে পড়েছে। ফলে তেমন গুরুতর না এমন জীবাণুকে মারতেও শেষ ভরসাস্থল হিসেবে ‘রিজার্ভ’ অস্ত্রের দিকে হাত দিতে হচ্ছে। এ যেন মশা মারতে কামান দাগা! ফলে হাসপাতালে আইসিইউতে মুমূর্ষু রোগীর ক্ষেত্রে যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হতো, তা এখন ওয়ার্ডে সাধারণ বেডের রোগীদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক ভাণ্ডার। </p> <p>কিন্তু এমন হলো কীভাবে? </p> <p>অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো একটি নির্দিষ্ট ডোজে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেতে হয়। কিন্তু আমরা অনেকাংশেই এই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছি। সামান্য অসুখেই ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করছি হরহামেশাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুই-এক দিন খাওয়ার পর অসুখ কমে গেলেই আবার ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছি! এতে হিতে বিপরীতটাই হচ্ছে সবসময়। কেননা অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার কম ওষুধ সেবনে রোগের উপসর্গ কমলেও ওই জীবাণুকে কিন্তু পুরোপুরি মেরে ফেলা সম্ভব হয় না। ফলে অবশিষ্ট জীবাণু পরবর্তীতে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করে। ফলে পরবর্তীতে কোনো অসুখে ওই অ্যান্টিবায়োটিকটি ব্যবহার করলে দেখা যায় সেটি আর কাজ করছে না! অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স দেখা দেয়। সামান্য অসুখেই তখন আরও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার পড়ে। এভাবে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সে অনুপাতে আমাদের হাতে নতুন করে তেমন অ্যান্টিবায়োটিক আর আসছে না। কেননা ওষুধ আবিষ্কার, প্রস্তুতকরণ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল —সবমিলিয়ে একটা বেশ লম্বা সময়ের প্রয়োজন। অথচ এই অল্প সময়েই জীবাণুরা আমাদেরই ভুলে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদেরকে পুরোপুরি অকেজো করে দিচ্ছে। </p> <p>এছাড়া পশু-পাখির ফার্মে প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় এ থেকেও অনেক অ্যান্টিবায়োটিক কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে দেশে প্রতিবছর এক লাখ ৭০ হাজার লোক মারা যায় এ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে। এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে নিকট ভবিষ্যতে হয়তো মহামারি রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে এ অবস্থা!</p> <p>এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহার রোধ করা উচিত। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ শুরু করার পর এর পুরো কোর্স শেষ করতে হবে। পশু-পাখি পালনে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধ করা দরকার। হাসপাতালকেন্দ্রীক সংক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।</p> <p>সূত্র: শিক্ষার্থী,রাজশাহী মেডিকেল কলেজ</p>