<p>ঘূর্ণিঝড় মিধিলি অতিক্রম করেছে পায়রা ও মোংলা বিমানবন্দর। সারা দেশের আকাশ তাই গোমড়া মুখে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। ৭ ও ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখানো হচ্ছে উপকূলীয় বন্দরগুলোকে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের আট জেলা। আঘাত হানতে পারে ৫-৮ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণেই যে এই জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।</p> <p>কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কারণেই বা কেন জলোচ্ছ্বাস হয়? এদের মধ্যে সম্পর্কটাই বা কী?</p> <p>সাধারণত অপ্রশস্ত, গভীর নয় এমন নদীপথ বা মোহনায় প্রবল জোয়ারের সময় তৈরি হওয়া উঁচু প্রাচীরের মতো উৎপন্ন তরঙ্গকে জলোচ্ছ্বাস বলা হয়। জলোচ্ছ্বাস সমুদ্রেও তৈরি হতে পারে। অবশ্য ঘূর্ণিঝড়ের সময়টাতেই জলোচ্ছ্বাস বেশি দেখা যায়। মূলত ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়। সহজ কথায়, সমুদ্রের পানি ফুলে-ফেঁপে উঁচু ঢেউ আকারে উপকূলে আঘাত হানলে তাকে আমরা জলোচ্ছ্বাস বলব। জলোচ্ছ্বাসও এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। স্রোতের বিপরীতে এগোতে থাকে বিধায় জলোচ্ছ্বাসের পানির ঢেউ স্বাভাবিক ঢেউয়ের সঙ্গে মিলে বিশাল প্রাচীরের দানবীয় ঢেউ গড়ে তোলে। </p> <p>সাধারণত সুনামি বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জলোচ্ছ্বাসের শুরুটা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের পানির ঢেউ বিশাল আকার ধারণ করে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত করে। ঘূর্ণিঝড়ের বেগ যত বেশি হবে, জলোচ্ছ্বাসের আকার বা হারও সমানুপাতিক বাড়বে। সঙ্গে বাড়বে ক্ষয়ক্ষতি, হতাহতও। </p> <p>জলোচ্ছ্বাসের মাঝেও পার্থক্য রয়েছে। কিছু জলোচ্ছ্বাস বড় আকারের হয়, কিছু পরিধি হয় ছোট। তবে বাংলাদেশে জলোচ্ছ্বাস, বান, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস (tidal-surge), ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাস (cyclonic-surge) এবং ঝোড়ো-জলোচ্ছ্বাস (storm-surge) নামগুলো সমার্থক হিসেবেই পরিচিত। ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক পানির বিশাল তরঙ্গকে ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাস বলা হয়। <br /> বায়ুর প্রবাহ ও চাপে সৃষ্ট সামুদ্রিক ঝড়ের কেন্দ্র ও তার চারপাশের বিশাল জলরাশি স্তম্ভের মতো উঁচু হয়ে ওঠে। দৈর্ঘ্যে কখনো কখনো প্রায় ছয়-সাত মিটার পর্যন্ত ফুলে ওঠে জলরাশির এই কুণ্ডলী। বায়ুতাড়িত এ ঝড় ঝোড়ো-জলোচ্ছ্বাস হিসেবে সামনে এগোয়। ঝোড়ো-জলোচ্ছ্বাস উপকূলে আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল জলরাশি প্রবল বেগে উপকূলে আছড়ে পড়ে। যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল বন্যা শুরু হয়। এ ধরনের সামুদ্রিক অস্থিরতাকে বলা হয় ঘূর্ণিতরঙ্গ বা cyclonic wave। যা সামুদ্রিক ঝড়ের শান্তকেন্দ্রে সৃষ্ট। আরেকটি সামুদ্রিক অস্থিরতার নাম ঘূর্ণিজোয়ার বা cyclonic tide। এটি তুলনামূলক বিশাল এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ বায়ুপ্রবাহের সময় উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের সাধারণ উচ্চতা বাড়লে এ জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এ দুটো ভিন্ন ধাঁচের সামুদ্রিক অস্থিরতার সঙ্গে ঝড়-ঝঞ্ঝা মিলিত হলে সেটি আবার ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাস নামে পরিচিতি পায়। </p> <p>বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিল বা মে মাসে এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের সময়টাতে ঘূর্ণিঝড় দানা বাঁধে। সময়ভেদে ছয় মিটার পর্যন্ত উঁচু হয় উপকূলে ছুটে আসা এসব জলোচ্ছ্বাস। যা প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রতিবছর গড়ে এক থেকে পাঁচটি প্রবল সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। এদের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাস সমুদ্র পেরিয়ে জনপরিসরের ২০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যেমন বলছিলাম, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতার সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতাও বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথির সংযোগ ঘটলে তো সোনায় সোহাগা অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। চাঁদ ও সূর্যের মিলিত আকর্ষণে সৃষ্ট প্রবল জোয়ারের ফলে জলোচ্ছ্বাসের পানির উচ্চতা অনেক বেশি হয়। সঙ্গে প্রবল বন্যার কারণ হয়।</p> <p>আমাদের উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর সাথে আসা ঝোড়ো-জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা সাধারণত তিন থেকে ছয় মিটার হয়। ভরা কাটাল বা জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা বেশি হয়। যা আমরা ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেখেছি। মেঘনার মোহনায় আঘাত করা ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসটি ছিল ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাস। ভরা জোয়ারের কারণে জলরাশির উচ্চতা ৩ থেকে ১০.৬ মিটার ছাড়িয়ে যায়। বাতাসে গতিবেগ ছিল ২২২ কিলোমিটার/ঘণ্টা। প্রায় তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারান।</p> <p>লেখক : শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ</p> <p>সূত্র : বাংলাপিডিয়া<br />  </p>