<p><strong>সপ্তদশ শতক, উলসথ্রপ, ইংল্যান্ড</strong><br /> উলসথ্রপের বাড়িতে আইজ্যাক নিউটন বসে আছেন, ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে। এই কামরাটা একান্তই তার। রাজ্যের জিনিসপত্রে ঠাসা। খাতায় অঙ্ক কষছেন, দুরবিন নিয়ে পরীক্ষা করছেন। করেছেন গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর পরীক্ষাটাও। কিন্তু গত দুই দিন একটা বিষয় তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। সেটা হলো, আলোর অদ্ভুত এক চরিত্র। আলোকে প্রতিফলিত হয়। এ জন্য তিনি মনে করেন আলো আসলে কণা। কণা বলেই প্রতিফলিত। এমন একটা কণা, যার ভর নেই। কিন্তু এসবও এখন আর তাকে চিন্তিত করছে না। তার চিন্তার কারণ আলোর অন্য একটা অদ্ভুত চরিত্র। আলো স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে যেতে পারে সহজেই। এটা নতুন কিছুই নয়। যত স্বচ্ছই হোক সব আলো কাচ ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারে না। এটাও অতটা চিন্তার বিষয় নয়। চিন্তা কারণ হলো, আলো যদি কণাই হয়, তাহলে কোনগুলো কাচ ভেদ করে যাবে, আর কোনগুলো শেষ পর্যন্ত প্রতিফলিত হবে?</p> <p>এটা জটিল এক ধাঁধা, নিউটন হিসাব করে দেখেছেন, কোন কণাগুলো প্রতিফলিত হবে, আর কোনটা কাচ ভেদ করে বেরিয়ে যাবে সেটা জানার কোনো উপায়ই নেই। কিন্তু আলোর কণারা কীভাবে জানবে, কে কে প্রতিফলিত হবে? ওদের কি বুদ্ধি আছে? চিন্তাটা যত গাঢ় হয়, নিউটন তত হতাশ হয়ে ওঠেন।</p> <p><strong>বিংশ শতাব্দীর ৪০-এর দশক, ক্যালটেক, যুক্তরাষ্ট্র</strong><br /> প্রায় ৪০০ বছর যেটা নিয়ে ভাবছিলেন, সেই একই দুর্ভাবনা ঘিরে ধরেছে বিখ্যাত বিজ্ঞানীর। নিউটনের যুগের মতো আলো এখন আর অতটা মিস্ট্রিয়াস ক্যারেকটর নয়। জানা গেছে, এর সঙ্গে অনেক কিছুই। যেমন নিউটন মনে করতেন আলো কণা দিয়ে তৈরি। কিন্তু এখন প্রমাণিত যে, আলো একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ। আলোর কণার নাম ফোটন। ফোটনের সেই অদ্ভুত চরিত্রটার জবাব এখনো মেলেনি। সবচেয়ে স্বচ্ছ কাচও  চার শতাংশ আলো প্রতিফলন করতে পারে। আলোর প্রতিফলন-প্রতিসরণ নির্ভর করে আলোর কণা ফোটনের ওপর। তার মানে আলোর কণাধর্মই নির্ধারণ করে দেয়, আলো কাচ বা অন্য বস্তুর ওপর পড়লে সেটা ওই বস্তুর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যাবে নাকি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসবে।</p> <p>নিউটনের সময় আলোর ফোটনদের আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। তাই অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া তাঁর জন্য অসম্ভব ছিল। কিন্তু এই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার যুগে আলোর ফোটনদের আলাদা করে শনাক্ত করার জন্য শক্তিশালী ডিটেকটর আছে। সেসব ডিটেকটর দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, স্বচ্ছ কাচের প্রতিফলনের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করা হয়েছে।</p> <p>রিচার্ড ফাইনম্যানের একটা খসড়া তৈরি করেন। তার বিখ্যাত লেকচার সিরিজের জন্য এটা নিয়ে আর্টিকেল তৈরি করবেন।</p> <p>১৯১৬ সালে ফাইনম্যানের সেই লেকচার সিরিজের একটা বই প্রাকাশ হয়। নাম<em> কিউইডি : দ্য স্ট্রেন্জ থিওরি অব লাইট</em>। এ প্রথম অধ্যায়েই আলোচনা করা হয়েছে এই সমস্যা নিয়ে। বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা যে তিমিরে রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। ফাইনম্যানও পারেননি স্বচ্ছ কাচে আলোর কণাদের এই প্রতিফলন রহস্যের সমাধান দিতে। তিনি দেখিয়েছেন, আলোর কাচের পুরুত্ব বাড়লে প্রতিফলন ক্ষমতা বাড়তে পারে। কিন্তু কখনোই শতভাগ ফোটন ভেদ করে যেতে পারে এমন কাচ কখনোই পাওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে তিনি আরেকটা বিষয়ও দেখিয়েছেন, আলোর কাচের পুরুত্ব বাড়ালে কাচের প্রতিফলন ক্ষমতা যতই বাড়ুক, কখনোই সেটা ১৬ শতাংশের বেশি হবে না। অর্থাৎ কাচের আলো প্রতিফলন ক্ষমতা সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।</p> <p>এখন সেই পুরোনো প্রশ্ন আসতে পারে, বাজারে অনেক কাচ আছে যেগুলো খুব কালো, তার ভেতর দিয়ে খুব কম আলো বেরিয়ে যেতে পারে। যেমন ভিআইপিদের গাড়ির জানালায় এ ধরনের কাচ রাখা হয়। ধরা যাক, একটা কালো কাচের প্রতিফলনক্ষমতা ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ সেই কাচে যে পরিমাণ ফোটন এসে পড়ে তার অর্ধেকই সে ফিরিয়ে দিতে পারে। কাচের বেশি বেশি আলো প্রতিফলন ক্ষমতা এমনি বাড়েনি। তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম পদ্ধতি। মানুষ কৃত্রিম উপায়ে কাচ তৈরির সময় কেমিক্যাল মিশিয়ে বাড়িয়েছে প্রতিফলন ক্ষমতা। কিন্তু এই কাচেও তো পুরোনো সমস্যাটা রয়ে গেছে। সেই কাচ কোন ৫০ শতাংশ আলো ফিরিয়ে দিচ্ছে, কেন ফিরিয়ে দিচ্ছে, সেটার সমাধান কিন্তু মেলেনি।</p> <p>তাহলে কি ধরে নেব, ফোটনদের বুদ্ধি আছে? ৪ শতাংশ ফোটন জানে তাদের প্রতিফলিত হতে হবে? না, ফোটনের বুদ্ধি থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সমস্যাটার গভীরে এখনো বিজ্ঞানীরা যেতে পারেননি। সমস্যাটা অতি প্রাচীন। সেই নিউটনের যুগের। সাড়ে তিন শ বছরেও এর সমাধান মেলেনি। আদৌ এর সমাধান মিলবে কি না, বলা যায় না। তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় তো কত ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটে। সেগুলোর কিছু কিছুর সমাধান তো আছেই। এই সমস্যাটার সমাধানও কি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দেবে? এর উত্তর পেতে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।</p> <p><a href="https://en.wikipedia.org/wiki/QED:_The_Strange_Theory_of_Light_and_Matter"><span style="color:#2980b9;">সূত্র: কিউইডি : দ্য স্ট্রেন্জ থিওরি অব লাইট/রিচার্ড ফাইনম্যান</span></a></p>