<p>রূপকথা লিখিয়ে হিসেবে সত্যজিতের খুব সুনাম ছিল না। তবু তিনি একটা বড়সড় রূপকথা লিখেছিলেন। নাম ‘কানাইয়ের কথা’। সত্যজিতের গল্পগুলোতে যেমন জমজমাট রোমাঞ্চ থাকে, কানাইয়ের কথা তার ধারে-কাছেও পৌঁছতে পারেনি। তবে গল্পের সেই কানাইয়ের একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। নিজেকে অদৃশ্য করতে পারত কানাই। এই ক্ষমতা দিয়েই অত্যাচারী রাজার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিল সে। </p> <p>কথা হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কি কানাই অদৃশ্য হতে পারে? কানাই রূপকথার চরিত্র, তাই এই বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় ছিল না সত্যজিৎ রায়ের। কিন্তু আমরা তো বিষয়টা নিয়ে ভাবতে পারি।</p> <p>লন্ডনের এক বিজ্ঞানী নিজেকে অদৃশ্য করার ফর্মুলা আবিষ্কার করলেন। গ্রিফিন তার নাম। শুধু ফর্মুলা আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি। নিজের ওপরেই করলেন আবিষ্কারের প্রথম পরীক্ষা। অদৃশ্য হলেন। তার পরই গ্রিফিনের মতিভ্রম হলো। অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা লাভের পর গোটা পৃথিবীর অধিশ্বর হতে চাইলেন। ব্যাংক ডাকাতি করলেন, একের পর এক মানবজাতির ক্ষতি করার নেশায় মেতে উঠলেন। </p> <p>এ ধরনের ঘটনায় প্রথমেই বিমূঢ় হয়ে পড়ে সরকার, প্রশাসন। অলৌকিতা, কুসংস্কার দানা বাঁধে সাধারণের মনে। তারপর একসময় বুঝতে পারে কোনো এক লোক নিজেকে অদৃশ্য করে একের পর এক ঘটিয়ে চলেছে দুষ্কর্ম। প্রশাসন নানা ফাঁদ পাতে গ্রিফিনকে ধরার জন্য। একে তো অদৃশ্য তার ওপর প্রচণ্ড মেধাবী মানুষ, তাকে ফাঁদে ফেলা অতটা সহজ হলো না। একের পর এক প্রশাসনের জাল ছিন্ন করে ধরাছোঁয়ার বাইরে অথচ নাকের ডগায় আঁততায়ীর মতো ঘুরে বেড়ালেন গ্রিফিন। অবশেষে প্রশাসন এক অভাবনীয় উপায় বের করল। রাস্তায় ছড়িয়ে রাখল চটচটে টাটকা রং। সেই রং পায়ে মেখে গেল গ্রিফিনের। পায়ের তলা দৃশমান হলো। ব্যস, এটুকু সূত্র ধরেই একসময় ধরা পড়ল অদৃশ্য আঁততায়ী।</p> <p>লন্ডন শহরে সত্যি সত্যি অদৃশ্য গ্রিফিনের তাণ্ডব চলেনি। সর্বকালের অন্যতম সেরা কল্পবিজ্ঞান লেখক এইচ জি ওয়েলসের মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছিল কল্পবিজ্ঞানে এক মাস্টারপিস ‘দ্য ইনভিজিবল ম্যান’। আশ্চর্য তার কাহিনির বুনন, আশ্চর্য এক গল্প! রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার কী নেই! শওয়া শত বছর পেরিয়ে গেছে। দ্য ইনভিজিবল ম্যানের জাদু আজও সমান মুগ্ধ করে এ কালের পাঠকদেরও। সেটাই এমনই যে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত উঠেপড়ে লেগেছিলেন ওয়েলসের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে। খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন জার্মান চিকিৎসক বিজ্ঞানী স্পোর্ৎজ হেমহোলৎজ। আস্ত কোনো প্রাণীকে তিনি অদৃশ্য করেননি। তবে কোনো এক প্রাণীর চামড়াকে মিথাইল স্যালিসাইলিক দ্রবণে কিছুদিন ডুবিয়ে রেখে দেন। তারপর দেখেন, সেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।</p> <p>এখন প্রশ্ন হলো, প্রাণীর চামড়া যদি অদৃশ্য করা সম্ভব হয়, তবে প্রাণী বা মানুষ কেন নয়? এখানেই সব সম্ভাবনা ভেঙে পড়ে। রাসায়নিক ও জীব বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে অদৃশ্য করা সম্ভব। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান কী বলছে? রসায়ন আর জীববিজ্ঞান যদি সেটা করতে পারেও তবু সমস্যা দেখা দেবে পদার্থবিদ্যায়। রীতিমতো অভিশাপ হয়ে উঠবে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটি। সমস্যাটা এতই প্রকট, কোনো মানুষই সেই অভিশাপ নিজের মাথায় নিতে চাইবে না। <br /> কী সেই সমস্যা? </p> <p>অদৃশ্য মানুষ কি নিজে দেখতে পাবে? </p> <p>জীববিজ্ঞান বলে কোনো মানুষের চোখের রেটিনা ঠিক ঠিকমতো কাজ করে, লেন্সেও যদি সমস্যা না থাকে, তবে সেই মানুষ দেখতে পাবে। দেখার আরও একটা শর্ত অবশ্য রয়েছে। সেটা মস্তিষ্ক। আসলে চোখ তো দেখে না, দেখে মস্তিষ্ক। চোখের লেন্স কোনো বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা আলোকরশ্মিকে একত্র (ফোকাসিং) করে। সেই আলো মস্তিষ্কের একটা রেটিনায় প্রতিবিম্ব তৈরি করে। সেই প্রতিবিম্বটিকেই মস্তিষ্ক আমাদের দেখায় বস্তু হিসেবে।</p> <p>আলো কোথায় প্রতিবিম্ব তৈরি করে? </p> <p>পানিতে, আয়নায়, এমনকি আলো প্রতিফলিত করতে পারে এ ধরনের যেকোনো বস্তুতে। বস্তুটা শুধু স্বচ্ছ না হলেই চলবে। কাচ স্বচ্চ। তবু কাচের ওপর বস্তুর প্রতিবিম্ব দেখা যায়। কারণ স্বচ্ছ হলেও কাচের প্রতিসারঙ্ক বাতাসের প্রতিসারঙ্কের সমান নয়। পৃথিবীতে বাতাসই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্বচ্ছ বস্তু। তার তুলনায় কাচ কিছুটা কম স্বচ্ছ। তাই কাচে কিছু আলো বাধা পায়। ঝাপসা হলেও কাচের ওপর বস্তুও প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। কিন্তু অদৃশ্য মস্তিষ্ক? </p> <p>অদৃশ্য মস্তিষ্কের প্রতিসারঙ্কও বাতাসের সমান হবে। আলো মস্তিষ্কে বাধা পাবে না। ভেদ করে চলে যাবে। তাই মস্তিষ্কের কোথাও বস্তুর প্রতিবিম্ব তৈরি হতে পারবে না। আর প্রতিবিম্বই যদি তৈরি না হয়, তাহলে বস্তুকে দেখা অসম্ভব। তাই এইচ জি ওয়েলসের গ্রিফিনের মতো কোনো অদৃশ্য মানুষ রাসায়নিকভাবে যদি তৈরি করাও যায়, তাতে লাভ হবে না। পুরোপুরি অন্ধ হয়ে থাকতে হবে তাকে।</p>