<p>বিশাল হলরুমটা কানায় কানায় পূর্ণ। দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বক্তার জন্য। বক্তা যেনতেন কেউ নন। বিখ্যাত গণিতবিদ ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। সেদিনের বক্তব্যের বিষয় পৃথিবীর আকার ও মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান নিয়ে। তিনি বললেন, পৃথিবী আসলে একটা গোলকের মতো। রাসেল বিজ্ঞানী মানুষ, তার বক্তব্য ও ব্যাখ্যা সবই আসবে বিজ্ঞানের ভেতর থেকে। কিন্তু মিথেরও শক্তি আছে। এখনো পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে পৃথিবী নিয়ে, মহাকাশ নিয়ে মিথগুলোকে। তাই রাসেল যখন বললেন, পৃথিবী ভেসে আছে শূন্যে। তখন এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন। বললেন,  ‘এতক্ষণ আপনি যা বললেন, সব ভুয়া।’</p> <p>রাসেল একটু অবাক হলেন। পরক্ষণে মুচকি হেসে বললেন, ‘তাহলে আপনিই বলুন পৃথিবী কীভাবে মহাবিশ্বে অবস্থান করছে।’</p> <p>বৃদ্ধা বললেন, ‘আপনি বলেছেন পৃথিবী গোল, এটা ভুল কথা। পৃথিবী আসলে থালার মতো চ্যাপ্টা।’ </p> <p>তখন রাসেল জানতে চাইলেন, ‘তাহলে পৃথিবী শূন্যে ভেসে আছে কীভাবে?’</p> <p>জবাবে বৃদ্ধা বললেন, ‘পৃথিবী শূন্যে ভেসে নেই। সেটা দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট কচ্ছপের পিঠের ওপর।’ </p> <p>তখন বিজ্ঞানী জানতে চাইলেন, ‘সেই কচ্ছপ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?’</p> <p>বৃদ্ধা বললেন, ‘সেটা দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা কচ্ছপে পিঠের ওপর।’</p> <p>‘নিচের কচ্ছপটা তাহলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?’</p> <p>বৃদ্ধা তখন ঝটপট জবাব দিলেন, ‘সেই কচ্ছপটা আরেকটা কচ্ছপের পিঠে। তার নিচের কচ্ছপটার নিচে আরেকটা তার নিচে আরেকটা...এভাবে অসংখ্য কচ্ছপের পিঠে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই পৃথিবী।’</p> <p>‘কিন্তু একসময় কচ্ছপের শেষ থাকবে। সেটা সবচেয়ে নিচের কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবে?’ রাসেল জিজ্ঞেস করলেন।</p> <p>বৃদ্ধা তখন বললেন, ‘কচ্ছপের কোনো শেষ নেই।’</p> <p>‘মাফ করবেন,’ বললেন রাসেল, ‘এরচেয়ে পৃথিবী মহাবিশ্ব শূন্যে ভেসে আছে–এ ভাবনাই কি বেশি যুক্তিসঙ্গত নয়?’</p> <p>বৃদ্ধা বললেন, ‘আপনি অনেক চালাক।’</p> <p>এ কথার পর আর কিছু বলার থাকে না। বৃদ্ধার সঙ্গে তর্ক বাদ দিয়ে রাসেল আবার বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। বৃদ্ধা যেটা বলেছেন, সেটা আসলে একটা প্যারাডক্স তৈরি করে। শুধু ওই বৃদ্ধা নয়, প্রাচীনকালে সব মানুষই বিশ্বাস করত পৃথিবী কিছু না কিছুর ওপর দাাঁড়িয়ে। যেমন কেউ কেউ মনে করেন, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে অতিকায় ষাঁড়ের শিংয়ের ওপর। এভাবে যে প্রাণীর ওপর দাঁড়িয়ে, সেটা আবার আরেকটা প্রাণীর ওপর দাঁড়িয়ে। পৃথিবীকে যদি এমন কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাহলে অসীমসংখ্যক প্রাণী লাগে। তবে অসীম আমরা বলি ঠিকই, কিন্তু সে তো বাস্তব নয়। কোনো কিছু যদি হিসাবের গণ্ডিতে বস্তুগত চেহারায় আনতে হয়, তাহলে অসীমের হিসাব সেখানে চলে না।</p> <p>তাই কচ্ছপ বা ষাঁড়ের গপ্পোটা আসলে একটা প্যারাডক্স তৈরি করে। পৃথিবীকে যদি কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সেই কোনো কিছুটাকেও তাহলে আরেকটা বস্তুর ওপর দাঁড়াতে হবে। শেষ ষাঁড় বা কচ্ছপটি তাহলে কীসের ওপর দাঁড়িয়ে? </p> <p>এ প্রশ্নের জবাব সেকালের কল্পনাবিলাসী পণ্ডিতদের কাছে ছিল না। কিন্তু বিজ্ঞানী জোহান কেপলার আর আইজ্যাক নিউটনের প্রতিষ্ঠিত করা মহাকর্ষ সূত্র সেই সমস্যার সমাধান করে দেয়। কচ্ছপের পিঠ থেকে তারা পৃথিবীকে নামিয়ে আনেন মহাশূন্যে। অবশ্য প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিলেন পৃথিবী গোলাকার। আর গোলাকার পৃথিবী ভেসে আছে মহাশূন্যে। কিন্তু তিনি একটা বড় ভুলও করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, এর চারপাশে ঘুরছে মহাবিশ্বের সব বস্তু! এখন আমরা জানি পৃথীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে পৃথিবীসহ মোট আটটি গ্রহ, অসংখ্য বামনগ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু ধুমকেতু।</p> <p>রাসেলের প্যারাডক্সের এই গল্পটার সত্যতা যাচাই করা যায়নি। মানে আদৌ কোনো বৃদ্ধার সঙ্গে রাসেলের কথাবার্তার অকাট্য প্রমাণ নেই। তবে একটস মজার ঘটনার কথা লিখেছেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার ‘আ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম’ বইয়ের শুরুতেই। সেই বইয়ে তিনি এক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর উদাহরণ টেনেছেন, বলেছেন সম্ভবত বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বার্ট্রান্ড রাসেল।</p> <p>রাসেলের সঙ্গে বৃদ্ধার এই তর্কের ঐতিহাসিক সত্যতা থাক বা না থাক, কচ্ছপের পিঠে পৃথিবীকে বসিয়ে দেয়ার এই ব্যাপারটা একটা প্রহেলিকা তৈরি করে–শেষ কচ্ছপটা কীসের ওপর দাঁড়িয়ে? আমরা নিত্যদিন যে সংখ্যা ব্যবহার করি, তার শেষ নেই। কারণ যত বড় সংখ্যাই আমরা নিই না কেন, তার সঙ্গে এক যোগ করলে আরেকটা সংখ্যা পাওয়া যাবে। নতুন সেই সংখ্যার সঙ্গে ১ যোগ করলে নতুন একটা সংখ্যা পাওয়া যাবে। এভাবে যত ইচ্ছা সংখ্যা আপনি ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু সংখ্যার ভাণ্ডার শেষ হবে না।</p>