চলছে সামাজিক অংশের মাংসের ভাগ-বাটোয়ারা
গ্রামের কোরবানিই পারফেক্ট!
আমাদের গ্রামের নাম খয়খাট পাড়া। এটি পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া থানায় অবস্থিত। গ্রামের পূর্বদিকের অংশ বা পাড়াটি আমাদের, যাতে আগে ছিলো ৬০/৬৫টি পরিবার, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫/৯০-এ। কৃষিই প্রধান জীবিকা হলেও গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের যারা মূলত পাথর শ্রমিক। তবে আমাদের পাড়ার কোরবানি এবং মাংস বন্টনের নিয়মকানুনগুলো আমার খুব পছন্দের যা সুষ্ঠু সামাজিক বন্টনের এক অপরুপ নিদর্শন মনে হয় অন্তত আমার কাছে। ঢাকা শহরে এসব দৃশ্য বিরল!
সেই বাল্যকাল থেকেই দেখে আসছি, ঈদের নামাজ শেষে কোরবানির জন্য রাখা গরু, ছাগলগুলো আমারদের বৈঠকখানায় এনে জড়ো করে এক এক করে জবেহ করা হতো। এরপর এখান থেকেই সুন্দরভাবে সব বন্টন হতো। লোকজন কাটাকুটির কাজও করতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ঘরে ঘরে বিরাজ করতো আনন্দ।
এবারো এর ব্যত্যয় হয়নি।
আজ ঈদ উল আযহার নামাজ শেষে ঘরে ফিরে সবাই যথারীতি কুরবানির প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলো। কলাপাতা, ছুরি, চাকু, খাটিয়া যোগাড় করে সবাই জড়ো হলো আমাদের বাড়ির নিকটবর্তী মাদ্রাসা মাঠে। হুজুর এসে এক এক করে ৬টি গরু ও ৭টি ছাগল জবাই দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে যে যার মতো কাটাকাটিতে লেগে গেলেন। একেক পশুর মাংস পাল্লা দিয়ে মেপে মেপে সমান তিনভাগ করে এক ভাগ সামাজিক অংশ রেখে দেয়া হলো মাঠের এক পাশে। এভাবে ৬টি গরুর সামাজিক অংশগুলো একত্র করে পরিবার হিসেবে তা ৮৬ ভাগে ভাগ করা হলো।
এভাবে ছাগলের মাংসগুলো আলাদাভাবে ভাগ করে ওখান থেকেই বিলিয়ে দেয়া হলো। তবে যারা কুরবানিতে শরীক হয়েছেন তারা কেউ সামাজিক এই অংশ নেয়নি। গ্রামের গরীব মানুষরা যাতে আরো বেশি বেশি মাংশ ভাগে পায় এজন্য সবাই এই সেকরিফাইসটা করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।
সামাজিক অংশ বন্টন শেষে দুই ভাগ চলে যায় বাড়িতে। সেখান থেকে একভাগ আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে রান্না করি বা সংরক্ষণ করি। বাকি একভাগ কিছু নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিলি করি এবং কিছু আত্মীয়কে দাওয়াত দিয়ে রান্না করে খাওয়াই। আগে মাংস সংরক্ষণের প্রযুক্তি ছিলো না বলে অনেকে শুঁটকি করেও রাখতো। এখন অবশ্য ফ্রিজ চলে এসেছে গ্রামে। তবে লো ভোল্টেজ বড় সমস্যা।
যাক, আমার কাছে মনে হয় পারফেক্ট কোরবানি দেয়া বলতে যা বোঝায় তা এই গ্রামেই হয়। এখানকার মানুষ গরীব হলেও তারা অন্যের হক মেরে শহুরে মানুষের মতো ডিপ ফ্রিজে মাংস রেখে সারা বছর খায় না।
সব ডিপে রেখে লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে ফকির মিসকিনকে নামকাওয়াস্তে কিছু মাংস দিয়ে দায়সারা কাজ তারা করে না।
গ্রামের এসব মানুষ ঈদের আগে ডিপ ফ্রিজও কেনে না। তারা গরীবের হকের মাংস কীভাবে রান্না করতে হয় সেই রেসিপির বইও কেনেন না।
তারা শুধু এটা ফিল করে, সারা বছর যারা মাংস কেনার সামর্থ রাখে না তাদের খুশি করার মাঝেই প্রকৃত সুখ। আর এটাই প্রকৃত কোরবানি বা সেকরিফাইস।
লেখক: আতাউর রহমান কাবুল, সাংবাদিক
ফেসবুক থেকে সংগৃহিত
(এই বিভাগে প্রকাশিত লেখা ও মন্তব্যের দায় একান্তই সংশ্লিষ্ট লেখক বা মন্তব্যকারীর, কালের কণ্ঠ কর্তৃপক্ষ এজন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়)
মন্তব্য