<p>বাবরি মসজিদের সাম্প্রতিক রায় নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি জাস্টিস অশোক কুমার গাংগুলির দুইটা লিগ্যাল পয়েন্ট খুব প্রণিধানযোগ্য। যদিও এই ঘটনাটা মোটেই শুধুমাত্র ভদ্রস্থ কোর্ট কাচারির আইনি বিষয় না, বিষয়টা রাজনৈতিক। তাই কোর্টের সিদ্ধান্তের চেয়েও এই ঘটনার রাজনৈতিক ডাইমেনশনটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি সংঘাতপূর্ণ, সংবেদনশীল ও পলিটিক্যাল ইস্যু। যখন আমি রাজনৈতিক লেখি তখন আমার লেখা যারা পড়েন তারা ভাবেন পলিটিক্স মানে রাজনৈতিক দল ও তাদের চিন্তা ভাবনার সংকলন। দল রাজনীতির একটি অংশ মাত্র। পলিটিক্স হলো পাওয়ারের ম্যাপ সেখানে যেমন দল আছে,  মত আছে বিশ্বাস আছে, অর্থ আছে।</p> <p>প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের প্রশাসনে কাজ করতেন এমন এক ভদ্রলোক এরিক লিউ ক্ষমতার এক সহজ ম্যাপ প্রদান করেন। উনার মতে, ক্ষমতার ছয় উৎস।  <br /> ১. ভায়োলেন্স তৈরির ক্ষমতা (যে কোনও অস্ত্রধারীর থাকে)  <br /> ২. সম্পদ বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা <br /> ৩. রাষ্ট্রক্ষমতা- সরকারি প্রশাসনিক ও আইনি ক্ষমতা <br /> ৪. সামাজিক আচার বা প্রথা, যেমনঃ ধর্ম <br /> ৫. আইডিয়া বা দর্শন, যেমন- ধর্ম, সোশ্যালিজম <br /> ৬. সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা বিপুল সংখ্যক মানুষ জমায়াত হলে যে ক্ষমতার সৃষ্টি হয়, যেমনঃ দল, আন্দোলন। পলিটিক্স হলো স্টাডি অফ পাওয়ার। ক্ষমতার মানচিত্র না বুঝলে, পুস্তকি আইন কানুন আর কলমের বিচারে এই ঘটনার ব্যাখা করা যাবে না। </p> <p>মূল ইস্যু কি?  এখানে মূল ইস্যু হলো- অযোধ্যার বাবরি মসজিদের জায়গাটা কার? হিন্দুদের বা মুসলমানদের? ইতিহাস কি বলে? যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে জায়গার মালিকানার এই ধরনের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক নির্ধারণীতে বিশ্বাসী না, তবুও যেভাবে দুনিয়া চলছে সেই আলোকেই বলছি। আমার মতের কোনও পলিটিক্যাল মূল্য নাই কারণ আমি একটা গরিব দেশের একজন ছাপোষা সরকারি কর্মচারি। জনাব গাঙ্গুলির দুই পয়েন্টে ফেরত যাই।</p> <p>১) ভারতের সংবিধানের বয়স সর্বোচ্চ ৭২ বছর, কারণ ভারতের জন্ম ১৯৪৭ সালে। বাবরি মসজিদে মুসলিমরা প্রার্থনা করে আসছে অন্তত ১৫০ বছর আগে থেকে (ভেঙে ফেলার আগ পর্যন্ত)। তাহলে অন্তত ১৫০ বছর ধরে এটি মসজিদ ছিল। প্রশ্ন হলো ৭২ বছরের পুরনো আইন দিয়ে ১৫০ বছরের পুরনো একটি মালিকানার ফয়সালা করা যায় কি না? সম্ভবত না, কারণ জুরিসপ্রুডেন্সে এটা রেট্রোস্পেকটিভ জাস্টিস। নতুন আইন করে পুরনো ঘটনার বিচারের মতো। যদিও এরকম ইতিহাস যে নাই তা না। এটি গাঙ্গুলি সাহেবের প্রথম বক্তব্য। </p> <p>উনি বলেন, এভাবে ২০০, ৩০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার মালিকানা কি সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারণ করতে পারে? মালিকানার সংজ্ঞা কি? মালিকানার বিষয়ে মুসলমানদের নেতারা গাঙ্গুলি বক্তব্যকেই সামনে আনছেন। বিপরীত দিকে হিন্দু নেতাদের বক্তব্য, সম্রাট বাবর রামমন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। ফলে, এখানে মূল মালিকানা হলো হিন্দুদের অর্থাৎ মন্দিরের। যদিও খনন করে সেরকম কোন এভিডেন্স পাওয়া যায়নি বলে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছে। যদি পাওয়াও যেত, তবে ১৫০ বছর ধরে যার মালিকানা আছে সে মালিক হতো নাকি ১৫০ বছর আগে যিনি মালিক ছিলেন তিনি মালিক হতেন? প্রশ্নটা লিগ্যাল প্র‍্যাকটিশনারদের ব্যাখার উপর ছাড়া যাক। </p> <p>যদি ধরে নেই  রেট্রোস্পেকটিভ বিচার করা যায়, তাহলে</p> <p>২) জনাব গাঙ্গুলির দ্বিতীয় পয়েন্ট- তবে এই রায়ের  মধ্য দিয়ে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মাচারের স্বাধীনতার ধারাটি লংঘিত হচ্ছে কি না? ১৫০ বছর ধরে বা আরো কম সময়ে, ধরুন ৫০ বছর ধরে যদি একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী যদি একটা স্থানকে উপাসনালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তবে সেটা অবৈধ ঘোষণা করা কি সেই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মাচারের স্বাধীনতার লংঘন কি না? ফলে এই রায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানতে পারল কি না? </p> <p>জনাব গাঙ্গুলি একজন সাবেক বিচারপতি। আইনি ও বিচারিক শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা নিয়েই উনার যত চিন্তা। আমার চিন্তা এই ঘটনার পলিটিক্স নিয়ে কারণ এই রায়ে একটি পলিটিক্সের ছায়া আছে। পলিটিক্সে যাওয়ার আগে একটা মেমরি রিফ্রেশার- </p> <p>পৃথিবীর আর কোনও জায়গা নিয়ে এরকম ধর্মীয় বিভাজন আছে যেখানে প্রত্যেকেই সেই জায়গার ঐতিহাসিক মালিকানা দাবি করেছে? সেই জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে? জ্বি আছে, জেরুজালেম। যেখানে ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি তিন ধর্মেরই নবী ইব্রাহিম (আ.) বা আব্রাহাম তার সন্তানকে ঈশ্বর বা আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করতে চেয়েছিলেন। যেটি আমাদের ঈদুল আযহার মূল ভিত্তি। কোন সন্তানকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.)? খ্রিস্টান ও ইহুদিরা বিশ্বাস করেন সেই সন্তান ছিলো আইজ্যাক বা ইসহাক (আ.),  মুসলমানেরা বিশ্বাস করে সেই সন্তান ইসমাইল (আ.)।  এই জেরুজালেমের জায়গার মালিকানা নিয়ে  ক্রুসেড থেকে শুরু করে এমন কোন যুদ্ধ নাই যা হয়নি। কারণ, সবাই ইব্রাহিম (আ.) এর মতের এবং সবাই এই জায়গার ঐতিহাসিক মালিকানা দাবি করেন। এখনও সেই যুদ্ধের ছায়া আরব রাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে দেখা যায়। এই যুদ্ধে কোর্ট বা বিচার বিভাগের কোন রায় টিকেনি, হস্তক্ষেপ করেছে এমনও খবর আমরা পাইনি। কারণ, এটি একটি পলিটিক্যাল ইস্যু যার সমাধান কোর্টে নাই। ধর্মের পলিটিক্স। </p> <p>বাবরি মসজিদের ইস্যুটিও অত্যাবশ্যকীয়ভাবে রাজনৈতিক। হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ও ক্ষমতার দ্বন্দ যেটিকে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করেছে। ভারতীয় দল বিজেপির রাজনৈতিক উথান বিশ্লেষণ করলে এটি পরিষ্কার যে, ধর্ম তাদের রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রশ্ন হলো, মালিকানার এই ঐতিহাসিক ভিত্তি কি ঠিক? ধর্মকে পুঁজি করে এই রাজনৈতিক যুদ্ধ কি ঠিক? ভুল ঠিক আপনার ভ্যালু জাজমেন্টের উপর নির্ভরশীল। আমি জানিনা কে ভুল কে ঠিক, কি ভুল কি ঠিক। আমি শুধু জানি এই সংঘাত-যুদ্ধ অনেক মৃত্যুর কারণ, অনেক রক্তপাতের কারণ, অনেক অশান্তির কারণ। এবং এই যুদ্ধ অনাবশ্যক। </p> <p>আধুনিক রাষ্ট্রে তিন বিভাগ- আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ আলাদা করার পিছনে শক্ত যুক্তি ছিলো তাত্ত্বিকদের। এর মধ্যে একটি হলো নিরপেক্ষতা; বিচার বিভাগের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা। কিন্তু বস্তুত পৃথিবীর কোথাও কখনোই এই তিন বিভাগ আলাদা ও পুরোপুরি স্বাধীন ছিলো না, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও না। এটি একটি পুস্তকীয় বিভাজন।</p> <p>কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ব্রেট ক্যাভানরকে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়োগ দেন তখন ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মাঝে কি ভয়ংকর কামড়াকামড়ি হয়েছে সেটি আপনারা দেখেছেন। ট্রাম্প জানেন, এই সুপ্রিম কোর্ট মোটা দাগে রিপাবলিকানদের বিপক্ষে রায় দিবে না বরং পক্ষেই থাকবে। কারণ, বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান। এটা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের অবস্থা হলে বিশ্বের বাকি জায়গাগুলোর কথা আলোচনা না করাই ভালো। এই ব্যাপারটা কি মন্টেস্কু ( সেপারেশন অফ পাওয়ার তত্ত্বের প্রবক্তা) , হ্যামিলটনেরা ( আমেরিকার জনকদের একজন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রবক্তা ) জানতেন না? জানতেন, তারা তাদের বেস্টটাই দিয়েছেন। তারা সেই সময়ে এসব তত্ত্ব দিয়ে যেসব সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলেন,  আমাদের এখনকার সমস্যাগুলো সেগুলো থেকে ভিন্ন। কোনও তত্ত্বই আসলে কালজয়ী না। কালজয়ী বলে কোনও ব্যাপারই নাই। </p> <p>ধর্ম নিয়ে এই যে রাজনীতি, সংঘাত এটি আরো বেশ কিছু সময় আমাদের অঞ্চলের মানুষের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। ভারতের কেউ কেউ চান এই যুদ্ধটা লেগেই থাকুক। তাদের জন্য এসব রায় বেশ সুখকরই বটে, হয়তোবা পরবর্তীতে ক্ষমতায় যাওয়ার সোপান।</p> <p><strong>সোহেল রানা</strong><br /> সহকারী সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার <br /> ও <br /> গ্রাজুয়েট রিসার্চ এসিসটেন্ট, হামফ্রে স্কুল অফ পাবলিক এফেয়ার্স, ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা, টুইন সিটিস<br /> সেইন্ট পল, মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র</p>