<p>বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের মিথ্যা অভিযোগে চাকরিচ্যুত বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৯ কর্মকর্তা চাকরি ফিরে পাননি আজও। তাদের অনেককে এখনো দেওয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব কর্মকর্তাদের চাকরিতে যোগদানের সুযোগ তৈরি হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করা প্রশাসন ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এখনো কোণঠাসা এসব কর্মকর্তা।</p> <p>২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে কথিত বৈঠক করার মিথ্যা অভিযোগে দুই যুগ্মসচিবসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৯ জনের মধ্যে জনপ্রশসন মন্ত্রণালয়ের এপিডির দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব ড. এ. কে. এম জাহাঙ্গীর, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল মান্নান, আইএমইডির বার্তা বাহক মো. মুজিবুল হক, পরিসংখ্যান বিভাগের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. নকিতুল্লাহ এবং সিএজি কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো. আব্দুল মান্নানকে কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও সিনিয়র সহকারী সচিব, এ. কে. এম. ইহসানুল হক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. বাদিউল কবীর, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, মো. জাহাঙ্গীর আলম, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাজী জহিরুল ইসলাম, পিআইডির অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. বেলাল হোসেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকতা মো. হুমায়ুন কবীর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. তফিকুল ইসলাম এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ইব্রাহীম মিয়াজি, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হোছাইন এবং অফিস সহায়ক আবুল হাসনাত, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস সহায়ক মো. মোজাহিদুল ইসলাম, অর্থ বিভাগের অফিস সহায়ক আজিম উদ্দিন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার অপারেটর শহীদুল ইসলামকে বিভাগীয় মামলা দিয়ে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেসময় বিষয়টি নিয়ে পুরো সচিবালয় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক।</p> <p>দীর্ঘ সাড়ে ১০ বছর মানবেতর জীবনযাপন করেছেন এসব কর্মকর্তা। হেয়প্রতিপন্ন হয়েছে নানাভাবে। একদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর চাকরিচ্যুত কয়েকজন চাকরি ফেরত পেলেও নিজের দপ্তর বা টেবিল-চেয়ার দেওয়া হয়নি তাদের। এখনও কোণঠাসা হয়ে আছে অনেকে। তাদের কেউ কেউ এখনো চাকরি ফেরত পাননি। তারা এখনো সচিবালয়ের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন। </p> <p>বৈষম্যের শিকার এসব কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আওয়ামী শাষনামলে ঠুনকো অপরাধে শাস্তির শিকার এসব কর্মকর্তাকে যারা পদায়ন বা পদোন্নতি দেবেন তারা আওয়ামী সরকারের নিয়োগকৃত কর্মকর্তা। ফলে তারা এসব কর্মকর্তারা কোনো সহযোগিতা করছেন না। এমনকি এসব বঞ্চিত কর্মকর্তা যাতে পদায়ন বা পদোন্নতি না পান এজন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। </p> <p>বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম বলেন, আমি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে রায় পেয়েছি, সরকার আপিল করেছে। প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে রায় পাওয়ার পর সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করেছে। সুপ্রিম কোর্টের লিভ টু আপিলে রায় পাওয়ার পরও সরকার উক্ত মামলা রিভিউ করেনি। একাধিকবার মামলাটি কার্যতালিকায় আসলেও সরকার পক্ষের হস্তক্ষেপে শুনানি হয়নি। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল দায়িত্ব গ্রহণের পরই মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি এমন কোন ব্যক্তি যে আমার মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পরও রিভিও করতে হয়? পরিবার নিয়ে ১০ বছর মানবেতর জীবনযাপন করেছি। ছেলে-মেয়েদের ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া ও লেখাপড়া করাতে পারিনি। এর দায় কে নেবে? এর সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তি দাবি করেন এই কর্মকর্তা।</p> <p>বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব মোহাম্মাদ তোহা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিগত ১০ বছর আমাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা পেলেও সরকার প্রতিহিংসাবশত আমাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছে। আমাদের কোনো কোনো কর্মকর্তার জিপি ফান্ডের টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতে দেয়নি। নিয়ামানুযায়ী সাসপেন্ড অবস্থায় যে বেতন-ভাতা প্রাপ্য তা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের মতো কেউ যেন এমন হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যাপারে সকলকে সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করছি।</p> <p>ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের ভাষ্য, খালেদা জিয়ার সঙ্গে এসব কর্মকর্তা দেখা করার বিষয়টি ছিল মিথ্যা। তবে এসব মিথ্যা কথায় ছড়ানোর পেছনে ছিল সচিবালয়ে নিয়োজিত কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাদের মধ্যে রয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব আব্দুল খালেক, সহকারী সচিব মো. নজরুল ইসলাম, মো. হাবিবুর রহমান হাবিব, কামাল হোসেন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহে আলম ও আব্দুল হাই। তারা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে তাদের দিয়ে ১৯ জনের নামে একটি মিথ্যা ও বানোয়াট রিপোর্ট সরবরাহ করে। এর ভিত্তিতে এসব কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। </p> <p>জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. মাসুদুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়টি নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ বিভাগ এপিডি দেখছে। আমার জানামতে, এসব বঞ্চিত কর্মকর্তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। ইতোমধ্যে কিছু কর্মকর্তার পেনশনের ব্যবস্থা হয়েছে। এ বিষয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ বিভাগ এপিডির অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে এপিডির যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ জানান, সে সময় যত বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল তাদের সবাই তাদের প্রকৃত প্রাপ্য ফিরে পাবেন। আপনারা দেখেছেন ইতোমধ্যে পুলিশের বেশ কিছু পদ বঞ্চিত ও চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছেন।</p>