<p>ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে সেই ২০১৩ সাল থেকেই। কিন্তু বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নিজ দেশে একের পর এক মামলা হলেও এই চুক্তির আওতায় তাকে ফেরানো যাবে–সেই সম্ভাবনা কার্যত নেই বলেই মনে করছেন দিল্লির পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা। <a href="https://www.bbc.com/bengali/articles/c20r9zvl9p1o" target="_blank">বিবিসি বাংলা</a>।</p> <p>বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সত্যিই যদি এ ধরনের কোনো অনুরোধ আসে, সে ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অবস্থান কী হবে সে বিষয়টি নিয়েও দিল্লি আপাতত মুখ খুলতে চাইছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল যেমন বলছেন, ‘যদি প্রত্যর্পণের কথা বলেন, তাহলে সেটা তো পুরোপুরি কাল্পনিক (হাইপোথেটিক্যাল) একটা প্রশ্ন। এ রকম পরিস্থিতিতে কাল্পনিক কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়াটা আমাদের রেওয়াজ নয়!’</p> <p>আপাতত নির্দিষ্ট জবাব এড়িয়ে গেলেও ঢাকার কাছ থেকে এই ধরনের অনুরোধ যে আগামী দিনে আসতে পারে, সেই সম্ভাবনা কিন্তু দিল্লি নাকচ করছে না। পাশাপাশি বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ মহল থেকেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে, এই সম্ভাবনাটা হয়তো খুব বেশি দিন আর ‘কাল্পনিক’ থাকবে না।</p> <p>যেমন বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গত সপ্তাহেই বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রুজু হচ্ছে তার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে ভারতকে এই প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হবে কি না। ‘সে ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যেকার চুক্তি অনুযায়ী তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হবে’, মন্তব্য করেছেন তিনি।</p> <p>তবে বাস্তবতা হলো, ওই চুক্তির আওতায় যদি প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানোও হয় তাহলেও সেই অনুরোধ রক্ষা করার কাজটা যে সহজ হবে না সেটা ঢাকারও বিলক্ষণ জানা। কারণ ওই চুক্তিতে এমন কতগুলো বিধান বা শর্ত আছে, যার যেকোনোটাকে ব্যবহার করে ভারত এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। নানা আইনি জটিলতা বা মারপ্যাঁচ দেখিয়েও সেই অনুরোধ ফেলে রাখতে পারে দিনের পর দিন। সবচেয়ে বড় কথা–শেখ হাসিনা বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে ভারতের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত বন্ধুদের একজন। ফলে তাকে বিচারের জন্য বা দণ্ডিত হলে শাস্তিভোগের জন্য বাংলাদেশের হাতে ভারত তুলে দেবে–বাস্তবে এই সম্ভাবনা কার্যত নেই বললেই চলে।</p> <p>এই পদক্ষেপের জন্য হাজারটা যুক্তি বের করাও কোনো কঠিন কাজ নয়। আর ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা যদি তৃতীয় কোনো দেশে গিয়ে আশ্রয় নেন তাহলে ভারতকে আর কোনো অস্বস্তিতেই পড়তে হবে না। এই কারণেই আপাতত প্রশ্নটিকে ‘কাল্পনিক’ বলে ভারত জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে। তবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ সত্যিই এলে কোন কোন যুক্তিতে তা ঝুলিয়ে রাখা বা নাকচ করা সম্ভব–এই প্রতিবেদনে সেটাই দেখা হয়েছে।</p> <p><strong>‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’</strong></p> <p>বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা আছে–আর সেটা হলো যার হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা যদি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’র হয় তাহলে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে। তবে কোন কোন অপরাধের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক’ বলা যাবে না, সেই তালিকাও বেশ লম্বা–এর মধ্যে হত্যা, গুম, অনিচ্ছাকৃত হত্যা ঘটানো, বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো ও সন্ত্রাসবাদের মতো নানা অপরাধ আছে।</p> <p>এখন গত দুই সপ্তাহে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যেসব মামলা রুজু হয়েছে তার মধ্যে হত্যা, গণহত্যা, গুম ও নির্যাতনেরও নানা অভিযোগ আছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে ‘রাজনৈতিক’ বলে খারিজ করা কঠিন। তার ওপর ২০১৬ সালে যখন মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়, তখন এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, যা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল।</p> <p>সংশোধিত চুক্তির ১০(৩) ধারায় বলা হয়েছিল, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেসব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ না-করলেও চলবে–শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।</p> <p>তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যেসব মামলা করা হয়েছে, তার কোনোটিতে যদি আদালত ‘ফেরার’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন, তাহলে তার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে তার হস্তান্তরের অনুরোধ জানাতে পারবে। কিন্তু এর পরও চুক্তিতে এমন কিছু ধারা আছে, যেগুলো প্রয়োগ করে অনুরোধ-প্রাপক দেশ তা খারিজ করার অধিকার রাখে।</p> <p>যেমন, অনুরোধ-প্রাপক দেশেও যদি ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে’র মামলা চলে, তাহলে সেটা দেখিয়ে অন্য দেশের অনুরোধ খারিজ করা যায়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে অবশ্য এটা প্রযোজ্য নয়, কারণ ভারতে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হচ্ছে না বা অচিরে হওয়ারও সম্ভাবনা নেই।</p> <p>দ্বিতীয় ধারাটি হলো, যদি অনুরোধ-প্রাপক দেশের মনে হয় ‘অভিযোগগুলো শুধু ন্যায়বিচারের স্বার্থে, সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি’– তাহলেও তাদের সেটি নাকচ করার ক্ষমতা থাকবে।</p> <p>অভিযোগগুলো যদি ‘সামরিক অপরাধে’র হয়– যা সাধারণ ফৌজদারি আইনের পরিধিতে পড়ে না তাহলেও একইভাবে অনুরোধ নাকচ করা যাবে। এখন ভারত যদি সত্যিই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের কোনো অনুরোধ পায়, তাহলে দ্বিতীয় ধারাটি প্রয়োগ করেই তা খারিজ করা যাবে বলে দিল্লিতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।</p> <p>স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংক আইডিএসএর সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক বলছিলেন, ‘প্রথমেই বলা দরকার, আমি মনে করি না বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাবে।’</p> <p>তার মতে, এতে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে–যে ঝুঁকিটা হয়তো বাংলাদেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া একটি সরকার নেবে না। তিনি সেই সঙ্গেই যোগ করেন, ‘তবে তার পরও যদি এই অনুরোধ জানানো হয়, তাহলেও সেটা রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক বলে মনে করার জন্য ভারতের হাতে কিন্তু যথেষ্ট যুক্তি থাকবে।’</p> <p>‘যেমন ধরুন, মঙ্গলবারই আদালতে তোলার সময় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে যেভাবে কিল-ঘুষি মারা হলো, কিংবা তার আগে সাবেক শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বা সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে আদালতে হেনস্তা হতে হলো তাহলে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হলে, শেখ হাসিনারও যে একই পরিণতি হবে না, এই নিশ্চয়তা কে দেবেন?’</p> <p>সোজা কথায়, এসব ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে ভারত অনায়াসেই বলতে পারবে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার পাবেন বলে তারা মনে করছে না এবং সে কারণেই তাকে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ ‘অভিযোগগুলো শুধু ন্যায়বিচারের স্বার্থে, সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি’ এই ধারাটি ব্যবহার করেই তখন প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচ করা যাবে বলে দিল্লিতে অনেক পর্যবেক্ষকের অভিমত।</p> <p><strong>সময়ক্ষেপণের রাস্তা?</strong></p> <p>তবে ভারতে আর একদল বিশ্লেষক মনে করেন, যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করার জন্য ভারতের কাছে কোনো অনুরোধ আসে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বা সরাসরি তা নাকচ না করে দিল্লি দিনের পর দিন তা ঝুলিয়েও রেখে দিতে পারে।</p> <p>ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ টিসিএ রাঘবন সোজাসুজি বলছেন, বিপদের মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে ভারত যেভাবে আশ্রয় দিয়েছে সেটাই ভারতের নীতি- তাকে ‘আরো বড় বিপদে ফেলা’টা ভারতের জন্য কোনো ‘অপশন’ হতেই পারে না! তার জন্য যেকোনো ‘উপায়’ বা যেকোনো ‘যুক্তি’ খুঁজে বের করাটাও তেমন কোনো সমস্যা নয় বলে মনে করেন তিনি।</p> <p>‘একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার পাশে এখন যদি আমরা না দাঁড়াই, তাহলে বিশ্বের কোথাও আর কোনো বন্ধু দেশের নেতা ভারতকে বিশ্বাস করতে পারবেন না, ভারতের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন না’, বলছেন মি. রাঘবন।</p> <p>আর এই ‘পাশে দাঁড়ানোর’ই একটা রাস্তা হতে পারে - শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চিত করে তোলা।</p> <p>কারণ এই ধরনের সব চুক্তিতেই নানা ‘লুপহোল’ বা ‘ফাঁকফোকর’ থাকে – যেগুলো কাজে লাগিয়ে আইনি বিশেষজ্ঞরা কয়েক মাস বা কয়েক বছর পর্যন্ত একটা অনুরোধকে স্থগিত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।</p> <p>শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও (যদি তার প্রত্যর্পণের অনুরোধ আসে) ভারতও একই ধরনের পথ নেবে বলে বহু বিশ্লেষক নিশ্চিত।</p> <p>ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই ধরনের চুক্তির আওতায় অনুরোধ মঞ্জুর হতে এমনিতেও অনেক সময় বছরের পর বছর লেগে যায়। তিনি বলছিলেন, ‘মুম্বাইয়ে ২৬/১১-র জঙ্গি হামলার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত তাহাউর হুসেন রানা–যিনি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক–তাকে হাতে পাওয়ার জন্য ভারত চেষ্টা চালাচ্ছে সেই ২০০৮ সাল থেকে। এখন ধরুন, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে কিন্তু সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। অন্য বহু দেশেরও আগে আমেরিকার সঙ্গে ভারত এই চুক্তি করেছে–ফলে এত দিনে তাকে তো ভারতের হাতে পেয়ে যাওয়াই উচিত ছিল, তাই না?’</p> <p>‘কিন্তু আমরা সবে গত সপ্তাহে (১৫ই অগাস্ট) দেখলাম ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালত রায় দিয়েছেন, রানাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। ইতিমধ্যেই প্রায় ১৬ বছর কেটে গেছে, এখন দেখুন হাতে পেতে আরো কত সময় লাগে’, বলছিলেন মি. চক্রবর্তী।</p> <p>ফলে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ভারতের কাছে কোনো অনুরোধ এলে সেটা যে কয়েক দিন বা কয়েক মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে– তা মনে করার কোনো কারণ নেই।</p> <p>আর তারও আগে যদি শেখ হাসিনা ভারত ছেড়ে তৃতীয় কোনো দেশের উদ্দেশে পাড়ি দেন (যে সম্ভাবনা দিল্লিতে সরকারি কর্মকর্তারা এখনো নাকচ করছেন না) তাহলে ওই ধরনের কোনো অনুরোধ আসার বা তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও প্রশ্ন উঠবে না।</p>