<p style="text-align:justify">কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ২০১৩ সালের ৫ মের মহাসমাবেশে যৌথ বাহিনীর রাতের অভিযান ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’ আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন হেফাজত নেতারা। </p> <p style="text-align:justify">তাঁরা বলছেন, ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচি পালনের সময় রাতের অন্ধকারে কার্যত গণহত্যা চালানো হয়েছিল। ওই ঘটনার প্রধান দুই কুশীলব ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।</p> <p style="text-align:justify">এ বিষয়ে সংগঠনের পাশাপাশি নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকেও একাধিক মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।<br /> বেনজীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানের মধ্যেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অন্যদিকে সরকার পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার হন জিয়া। তিনি বর্তমানে রিমান্ডে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সেই রাতে শাপলা চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে যৌথভাবে কুশীলব ছিলেন বেনজীর ও জিয়া। মতিঝিলকে কেন্দ্র করে চারপাশের এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। ভোর ৫টার দিকে পুরো এলাকা খালি হয়ে যায়। তার আগে সেখানে সৃষ্ট গণহত্যার ঘটনায় নিহতদের মরদেহ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগও তুলেছিলেন হেফাজত নেতারা। সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন বেনজীর আহমেদ।</p> <p style="text-align:justify">২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে সারা দেশে সহিংসতায় ২৮ জন নিহতের কথা বলেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে হেফাজতের পক্ষ থেকে পুলিশের এই দাবি বরাবরই নাকচ করা হয়। তাদের দাবি, ওই রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">হেফাজত নেতারা বলেছেন, হেফাজতের ওই কর্মসূচি ভণ্ডুল করার জন্য সেই সময় র‌্যাবের এডিজি অপারেশন কর্নেল জিয়াউল আহসান এবং ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে সব সড়কবাতি নিভিয়ে দিয়ে হেফাজত নেতাকর্মীদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এই ঘটনায় আহতদের মধ্যে ১০ হাজার নেতাকর্মী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। </p> <p style="text-align:justify">এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কেন্দ্রীয় কিমিটির যুগ্ম মহাসচিব এবং ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিতে আমরা নির্মম পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। দেশে-বিদেশে সবাই সে সময় তা দেখেছে। এ ঘটনার নিন্দা জানানোর কোনো ভাষা নেই। এই নির্মম গণহত্যার জন্য আমরা ১৩ বছর যাবৎ বিচার চেয়ে আসছি। কিন্তু বিচার করবে তো দূরের কথা বরং তৎকালীন সরকার বিভিন্ন মামলা দিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের চেপে ধরেছিল। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে আমরা মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শহীদদের পরিবারের পক্ষ থেকেও ব্যক্তি উদ্যোগে মামলা করা হবে।’</p> <p style="text-align:justify">বেনজীর ও জিয়ার নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে মন্তব্য করে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘তাঁরা এই ঘটনার অন্যতম খলনায়ক। তাঁরা অপরাধী, তাঁরা হত্যাকারী। তাই সেই হিসাবে তাঁদের বিচার অবশ্যই চাই। মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যায় কি না, এসব আইনগত বিষয় আলাপ-আলোচনা করে আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে প্রস্তুতি চলছে।’</p> <p style="text-align:justify">এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, ‘শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিতে তৎকালীন সরকারের নির্যাতনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন আমরা অতিদ্রুত তাঁদের নাম উল্লেখ করে মামলা করব। হেফাজত ইসলামের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে এ মামলা করা হবে। এ জন্য আমরা আইনজীবীদের সঙ্গেও কথা বলছি। খুব শিগগির এ মামলা করা হবে।’</p> <p style="text-align:justify">এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আলেমদের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছে, যাদের নির্দেশে করেছে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, যাতে অন্য কেউ নীতির প্রশ্নে গুলি চালিয়ে হত্যা করার সাহস না পায়।’</p> <p style="text-align:justify">হেফাজতের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোটাদাগে তখনকার আইজিপি শহীদুল হকসহ বেনজীর আহমেদ ও জিয়াউল আহসান সরাসরি আমাদের নেতাকর্মী হত্যার সঙ্গে জড়িত। এই পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদে ৫ মে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা তখন নিজেদের এতটাই প্রতাপশালী মনে করতেন যে তাঁদের কাছে দেশ ও জাতি নিরাপদ ছিল না। তাঁদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা দৃষ্টান্তমূলক হয়ে থাকে। আমরা তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’</p> <p style="text-align:justify">হেফাজতে ইসলামের সহকারী মহাসচিব জাকারিয়া নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এই ঘটনার জন্য মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হবে।’</p> <p style="text-align:justify">এদিকে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মীর ইদ্রিস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে র‌্যাব-পুলিশ পরিকল্পিত নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে যেসব হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে সেগুলোর প্রতিটি ঘটনার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।</p> <p style="text-align:justify">১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া বেনজীর আহমেদকে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি’, যাঁর বক্তব্য ও বিবৃতিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। বিরোধী দলগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশ বাহিনীকে সরকারি দলের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন বেনজীর আহমেদ। এ ছাড়া গত এক দশকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সময় ‘বিরোধী দল দমনে’ নানা পদক্ষেপ নিয়েও বারবার আলোচনায় আসেন তিনি।</p> <p style="text-align:justify">অন্যদিকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ ও নিধন, আড়ি পাতার যন্ত্র পেগাসাস সফটওয়্যার ক্রয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে করা আবেদনে এমনটাই দাবি করেছে পুলিশ। এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এসব ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।</p>