<article> <p style="text-align: justify;">দেশে বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে। ভেজাল খাদ্য তৈরিতে রাসায়নিক থেকে শুরু করে ভারী ধাতব পদার্থের মতো এমন উপাদান মেশানো হচ্ছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের অভিযান-পরবর্তী খাদ্যমান ও বিশুদ্ধতা যাচাই পরীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।</p> <p style="text-align: justify;">সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে সঠিক ও নিয়মিত তদারকির অভাবে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে ভেজাল খাদ্য তৈরি করছে, যার একমাত্র লক্ষ্য অতিমুনাফা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল খাদ্যে থাকা রাসায়নিক ও ধাতব পদার্থের প্রভাবে কিডনি-লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ। খাদ্য নিরাপদ রাখতে কাজ করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। দুই প্রতিষ্ঠানেরই রয়েছে পণ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা।</p> </article> <p style="text-align: justify;"> </p> <p style="text-align: justify;">অন্যদিকে ভোক্তাদের অভিযোগ ও বাজারে অভিযান চালিয়ে ভেজাল পণ্য, দাম নিয়ন্ত্রণ করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধ করতে কাজ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে বলা হচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল মেশানো ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তারা বিচার ও শাস্তির ঊর্ধ্বে থেকে যাচ্ছে বলে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।</p> <article> <p style="text-align: justify;">বিএফএসএ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজার থেকে ৪৭ ধরনের খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করে সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন পরীক্ষাগারে (ল্যাব) পরীক্ষা করে। এসব খাদ্যপণ্য ৬১টি মানদণ্ডে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে পরীক্ষায় পাওয়া ফলাফল অনুসারে ৩৪টি মানসম্মত ছিল। আর ২৭টিতে বিরূপ ফল পাওয়া যায়। এসব খাদ্যপণ্য সঠিক মানের ছিল না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অন্যদিকে ১৫ ধরনের খাদ্যপণ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে রয়েছে পাউরুটি, গুড়, সস, মাংস, শুঁটকি মাছ, গুঁড়া দুধ, পাস্তুরিত তরল দুধ, মিষ্টিজাতীয় পণ্য, কোমল পানীয়, আচার, মোরব্বা, জিলাপি, পানি, ফলের রস ও মধু।</p> <p style="text-align: justify;">গত অর্থবছর বিএফএসএ সারা দেশ থেকে পাউরুটি, পাউরুটি তৈরির উপাদান, বিস্কুট ও কেকের মোট ১৬৭টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠায়। এর ১৬৪টি নমুনার মধ্যে ১২টিতে ক্ষতিকর পটাসিয়াম ব্রোমেট পাওয়া যায়। একইভাবে কোমল পানীয়ের ২৬টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৯টিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন পাওয়া যায়। জিলাপি, গুড়, মোরব্বা, মিছরি ও মোয়ার ৮৯টি নমুনায় হাইড্রোজের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১৩টিতে হাইড্রোজের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ১০টি গুড়ের নমুনায় পটাসিয়াম-অ্যালুমিনিয়াম সালফেট ও টোটাল সারফেস অ্যাক্টিভ এজেন্টের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">এর মধ্যে ৯টিতেই পটাসিয়াম-অ্যালুমিনিয়াম সালফেটের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের সসের মোট ৭৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ৬২টি নমুনায় অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণে বেনজয়িক এসিড পাওয়া যায়। ১৬টিতে মাত্রাতিরিক্ত বেনজয়িক এসিড ছিল।</p> <p style="text-align: justify;">আচারের মধ্যেও বেনজয়িক এসিড ব্যবহার করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেসব আচারের নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত বেনজয়িক এসিড পাওয়া গেছে, সেগুলো ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার পরীক্ষা করা হয়। এর ৩৭টি নমুনার মধ্যে ২৮টিতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়েও কম বেনজয়িক এসিড ছিল। কিন্তু ৯টিতে মাত্রাতিরিক্ত বেনজয়িক এসিড পাওয়া যায়।</p> <p style="text-align: justify;">এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হসপিটালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এসব পদার্থের কোনোটাই খাদ্য শ্রেণিভুক্ত নয়। খাদ্যের সঙ্গে যদি ক্ষতিকর এসব (পটাসিয়াম ব্রোমেট, বেনজয়িক এসিড, হাইড্রোজ, অননুমোদিত কৃত্রিম রং, পটাসিয়াম-অ্যালুমিনিয়াম সালফেট) পদার্থ মেশানো হয়, তাহলে লিভার ও কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে হারাতে থাকে। এভাবে একসময় লিভার-কিডনি অকেজো হয়ে যায়। পাকস্থলীতে প্রদাহ হয়। হজমে গণ্ডগোল দেখা দেয়। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণ করলে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগও দেখা দেয়। </p> <p style="text-align: justify;">খাদ্যপণ্যে ভেজাল রোধে বিএফএসএ জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা মনে করেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের চেয়ে ভোক্তাদের সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p style="text-align: justify;">পণ্যে ভেজাল শনাক্ত ও রোধে সম্প্রতি চীন থেকে সাতটি ভ্রাম্যমাণ ল্যাব নিয়ে এসেছে বিএফএসএ। এর মাধ্যমে সারা দেশে খাদ্য ও খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করা হবে।</p> <p style="text-align: justify;">এসব ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে যদি খাদ্যে ভেজাল পাওয়া যায়, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান বিএফএসএর সদস্য আবু নূর মো. শামসুজ্জামান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, এই ল্যাবে পরীক্ষা করা হলুদের গুঁড়ায় লেড ক্রোমেট, মরিচের গুঁড়ায় ইটের গুঁড়া, গোলমরিচে পেঁপে বীজ, শাক-সবজি, ফলমূলে রং ও বালাইনাশকের মাত্রা, পাউরুটিতে ক্ষতিকর পটাসিয়াম ব্রোমেট, খাদ্যে অননুমোদিত কৃত্রিম রং, খাদ্যে ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতিসহ আরো বেশ কিছু উপাদান পরীক্ষা করা যাবে।</p> <p style="text-align: justify;"><b>ভোক্তার ভাষ্য</b></p> <p style="text-align: justify;">রাজধানীর বাড্ডা এলাকার মো. বাবু মোটরসাইকেল দিয়ে রাইড শেয়ার করেন। বনানী মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী খুঁজছিলেন। কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, দুপুরে কলা আর পাউরুটি খেয়েছেন। বললেন, ‘যেখানে-সেখানে কলা-পাউরুটি খাওয়া ঠিক না। এগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষতিকর জিনিস আছে, যেগুলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। যেগুলো হাতে তৈরি হয় সেগুলোতে ঘাম লাগে, জীবাণু তৈরি হয়। কিন্তু কী করব? ভেজালমুক্ত খাবার তো পাচ্ছি না।’</p> <p style="text-align: justify;"><b>সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযান</b></p> <p style="text-align: justify;">গত ৯ মে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে অভিযান চলে। এ সময় নেসলে কম্পানির নেসক্যাফে কফি নকল করে বিক্রির অপরাধে হাজি মিজান স্টোরকে ২০ হাজার টাকা, মক্কা ও ইউসুফ স্টোরকে ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। অভিযানে ১১৭ জার নকল কফি জব্দ করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">একই দিন ভোক্তা অধিদপ্তরের গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শরিফুল ইসলাম কালিয়াকৈরের আঁখি সাথী আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে অভিযান চালান। এ সময় আইসক্রিমে ক্ষতিকর রং ব্যবহার করায় ওই প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">গত ৭ মে তারিখে ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (মেট্রো) মো. আবদুস সালাম দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী একতা ফল মার্কেটে অভিযান চালান। এ সময় ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে কলা পাকানোর দায়ে মেসার্স হাওলাদার এন্টারপ্রাইজকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">অনুমতি না নিয়ে মানহীন পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠানটি গত ১৫ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ার আওলাদ হোসেন মার্কেটে অভিযান চালায়। এ সময় প্রাইম সুইটস অ্যান্ড বেকারি লিমিটেডকে বিএসটিআইয়ের সনদ না নিয়ে পাউরুটি, বিস্কুট, কেক, ফার্মেন্টেড মিল্ক এবং ঘি উৎপাদন ও বাজারজাত করার অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">ভেজাল রোধে করণীয় সম্পর্কে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সরাসরি ভেজাল পণ্য যাচাই করতে পারি না। যেসব নামি ব্র্যান্ডের পণ্য আমদানি হয়, সেগুলোর নামে যদি উৎপাদন বা প্যাকেটজাত করা পণ্য দেখি, তখন তো আর টেস্ট করার দরকার হয় না। সঙ্গে সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদের জনবল আরো বাড়ানো হলে আরো বেশি তদারক করা সম্ভব হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় সব খাবারেই বিষাক্ত কেমিক্যাল পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো খুবই অ্যালার্মিং। বিএসটিআই লাইসেন্স দিয়েই ক্ষান্ত। মাঠ পর্যায়ে তাদের তেমন তদারকি নাই। ক্যাব জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিদপ্তর সচেতনতা নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু শুধু সচেতনতা দিয়ে কাজ হবে না। এখানে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">বিএসটিআইয়ের প্রশাসন বিভাগের সাবেক পরিচালক মো. তাহের জামিল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা বারবার তাদের ধরন পাল্টায়। এর পরও বিএসটিআই মানুষকে সচেতন করাসহ অভিযান এবং নজরদারি বাড়িয়েছে।’</p> </article>