<p>কত স্মৃতি, আবেগ, মায়া ভালোবাসা ঘিরে আছে এই ভবনের প্রতিটি ইটের সঙ্গে। শত বছরের পুরনো লাইব্রেরিতে চামড়ায় বাঁধানো বই কিংবা বিএনসিসির ই কম্পানির ক্যাডেট রুম। নিচ তলায় কেচি গেটের বাঁ পাশে নিলুফা আপার হাজারো চেষ্টায় গড়ে তোলা কালচারাল ক্লাব। লাল অমসৃণ পাটের কার্পেটে  নামাজ পড়া। দোতালায় সিঁড়ির বাঁ পাশে বিশাল ক্লাস রুম যেখানে পঞ্চমের বৃত্তি কোচিংয়ের ক্লাস হতো, কত দুষ্টুমি সবই হারিয়ে যাবে হাতুড়ির গায়েতির ধাক্কায় পরে যাওয়া ইটগুলোর সঙ্গে সঙ্গে।</p> <p>সম্প্রতি নিজের স্কুল জীবনের স্মৃতির আবেগঘন প্রকাশে কথাগুলো নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী মাহবুব হাসান। নিজের এই পোস্টটি তিনি দেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রাঙ্গণে অবস্থিত প্রায় তিন শ বছর পুরাতন স্থাপনা ভাঙার খবরে।</p> <p>উপমহাদেশের একমাত্র ইংলিশ স্কুল ও বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম সূতিকাগার ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরব বিস্ময়কর। ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ তথা অখণ্ড ভারতের প্রথম সরকারি স্কুল হিসেবে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৮৯ বছরে পা রাখা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ঢাকার সদরঘাটে ১ নম্বর লয়াল স্ট্রিটে। এই বাংলার প্রথম সরকারি স্কুল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ঢাকা কলেজ, ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার এই ধারাবাহিকতার সূচনায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মহান ব্রত নিয়ে স্কুলটির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী স্কুলটিকে তার মূল ভবন থেকে সরিয়ে সেই ভবনটিকে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান করে। ফলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সূচনালগ্ন থেকেই দেশ ও বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গের বিদ্যাপীঠ হিসেবে বিদ্যালয়টি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বর্তমানে বিদ্যালয়টি একক প্রশাসনাধীন দুটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ নাগাদ স্কুলের পুরাতন ভবনটি পরিত্যক্ত হিসেবে ধরা হয়। ২০১২ অথবা ২০১৩-এর আগে পর্যন্ত শুধু টিচার্স রুম, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকের অফিস আর একটি স্টাফ রুম ছিল। গতকাল বুধবার দুপুরে স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ভবন ভাঙার কাজ শুরু করেছে শ্রমিকরা। ওপর তলার মোটা কাঠ ও দরজার কাঠ খুলে ফেলা হয়েছে। ভবনের নিচে ট্রাকে কাঠ লোড করছে কয়েকজন শ্রমিক। এছাড়া ওপর তলায় তিনজন শ্রমিক দেয়াল ভাঙার কাজ করছে। তবে দুজন দায়িত্বরত ব্যক্তি যেদিকে ভবন ভাঙা হচ্ছে, সেদিকে যেতে নিষেধ করেন। দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বলেন, প্রায় দুই শ বছরের পুরাতন ভবন ছিল এটি। ছাত্রছাত্রীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে ভেঙে ফেলা হচ্ছে বলে জেনেছি।</p> <p>জানা যায়, মা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ভাঙার কাজটি পেয়েছে। ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকার টেন্ডার কাজ পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। গতকাল মঙ্গলবার থেকে ভবন ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। তিন মাস সময় লাগবে ভবন ভাঙতে।</p> <p>স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আরিফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন করা হবে। আশা করছি এটা হলে শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুম সংকট কেটে যাবে।’</p> <p>এক শিক্ষক জানান, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিছুদিন আগেও এক অভিভাবকের মাথায় ইট পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাই এখানে নতুন ভবন করা হবে। এখানে কোনো ম্যানেজিং কমিটি নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে ডিসি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন।</p> <p>স্কুলটির পুরাতন ভবনটি ভাঙার খবরে সাবেক শিক্ষার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ‘ঢাকা কলেজিয়েট সারকাজম’ নামে একটি ফেসবুক পেজে এবং ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে স্মৃতিচারণের পাশাপাশি এটিকে কেন সংরক্ষণ করা হচ্ছে না সেই প্রশ্ন অনেকের। ‘ঢাকা কলেজিয়েট সারকাজম’ নামে ফেসবুক পেজে ‘ভেঙে ফেলা হচ্ছে ১৮৯ বছরের ইতিহাস বিজড়িত প্রাণের স্কুলের পুরনো ভবন’ ক্যাপশন দিয়ে কয়েকটি ছবিসহ পোস্ট করেছেন কোনো এক শিক্ষার্থী। পোস্টের নিচে অনেক মন্তব্য করেছেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। যেখানে দেখা যায়, সোহান আজাদ নামে একজন লিখেছেন, ‘এ ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় ভাবিনি যে ঘরও ছেড়ে যাবে আমায়’। ইফতিখার রায়হান ইফতি নামে আরেকজন লিখেন, ‘অনেক স্মৃতি, আবেগ, মায়া ও ভালোবাসা জড়ানো দালান’। আসাদুজ্জামান তুহিন নামে আরেক সাবেক শিক্ষার্থী লিখেন, ‘এ বিল্ডিংটার সামনের লবিতে নিচে মাঠে পিটি করার সময় পতাকা উত্তোলন করা হতো, আমরা এ পতাকার লোহার পাইপ বেয়ে এই ভবনের ওপরের লবিতে উঠতাম, লবী লাগোয়া ছিল শিক্ষকদের মিলনায়তন বা কক্ষ’। নূর নবী পলাশ নামে আরেকজন লিখেন, ‘দ্বিতীয় তালায় ক্লাস করেছি। পেছনে নিচ তালায় ক্লাস করেছি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম।</p> <p>নিচ তলায় নামাজ আদায় করতাম প্রায় সময়। অনেক স্মৃতি। যেহেতু ব্যবহার অনুপযোগী ভেঙে নতুন ভবন হউক। এম এইচ সজীব নামে একজন লিখেছেন, ‘ইতিহাস হিসাবেই রাখা উচিত ছিল’। আরেকজন লিখেন, ‘সংস্করণ করলেই তো হয়’। কেউ কেউ লিখেছেন, ভবনটি কেন সংরক্ষণ করা হচ্ছে না সেটি তাদের বোধগম্য নয়। এমন অন্তত অর্ধশত মন্তব্য করেছেন সাবেক শিক্ষার্থীরা।</p> <p>ভবনটি সংরক্ষণের তালিকায় আছে কিনা জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রত্নতত্ত্ব ও সংরক্ষণ শাখার উপ-পরিচালক মো. আমিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশ কিছু ক্রাইটেরিয়া মেনে সংরক্ষণের তালিকায় যুক্ত করা হয়। কলেজিয়েট স্কুলের ভবনটি তালিকায় আছে কিনা সেটি দেখে বলতে হবে।’</p> <p>আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্কুলের পুরাতন ভবনটি আগে ধ্বংস করা হয়েছে। যে ভবনটি ভাঙা হচ্ছে এটি মুগল আমলের প্রমাণ পাই আমরা দেয়ালের নির্মাণ শৈলীতে। এটার ওপর পরে ভেতরে-বাইরে কাজ করা হয়েছে। আমরা এই দিকে মুগল আমলের কোনো স্থাপনা পাই না। পেলেও বিক্ষিপ্তভাবে পাই। ঢাকার ইতিহাস নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। গবেষণার জন্য এগুলো সংরক্ষণ করা যায়। ভবনটি সংস্কার করে লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বছর দুয়েক আগে এটি ভাঙার প্রস্তাবনা ছিল। পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসা হয়। এখন আবার কেন এটি করা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না। ঢাকার অনেক ঐতিহ্যবাহী ভবন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আরেকটি কথা হচ্ছে হাইকোর্টের নির্দেশে তো এসব ভবন ভাঙা বন্ধ আছে। তালিকায় এই ভবনটিও আছে। এর মাধ্যমে তো হাইকোর্টের অবমাননা করা হচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরে স্কুল প্রাঙ্গণে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী দ্বিতল ভবনটি ভাঙার কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভবনটির দরজা জানালা  ভেঙে অপসারণ করা হয়েছে এবং দুই এক জায়গায় একতলার ছাদও ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্কুলের এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ভবনটি ভেঙে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।</p> <p><strong>ভবন ভাঙা বন্ধের দাবিতে আজ কলেজিয়েট স্কুলের সামনে মানববন্ধন</strong><br /> হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে ঢাকা মহানগরীর প্রাচীনতম বিদ্যালয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রাঙ্গণে অবস্থিত প্রায় তিন শ বছরের পুরাতন স্থাপনা ভাঙার প্রতিবাদে মানববন্ধন করবে আরবান স্টাডি গ্রুপ। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সামনে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।</p>