<p>শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিদিন ১ ঘণ্টার করে খেলাধুলা ও শারীরিক সক্রিয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ন্যূনতম ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা (খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি) থাকা উচিত। এই হিসেবে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য সোয়া দুই একর খোলা জায়গা এবং এক একর খেলার মাঠের প্রয়োজন। অথচ ঢাকা শহরের মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ খেলাধুলার পরিষেবার মধ্যে বাস করেন। </p> <p>মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১ টায় ইনস্টিটিউট ফর প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর যৌথ উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জাল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘দেশের নগর এলাকার খেলার মাঠের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। </p> <p>সভায় বক্তারা বলেন, ‘ইউএন-হ্যাবিটেট এর মতে হাঁটা দূরত্বে খেলার মাঠ, সবুজ এলাকা থাকা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী যে কোন আবাসন এলাকার ন্যূনতম ১০ ভাগ খেলার মাঠ-পার্ক প্রভৃতি সুবিধার জন্য বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। অতি ঘন নগর এলাকায় প্রতি আধা বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জনসংখ্যা বিবেচনায় ন্যূনতম একটি খেলার মাঠ থাকা প্রয়োজন। সেখানে ঢাকা শহরের মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ খেলাধুলার পরিষেবার মধ্যে বাস করেন। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও আছে খেলার মাঠের তীব্র সংকট। সাম্প্রতিক সময়ে নগর এলাকার মাঠ-পার্ক উন্নয়নে গৃহীত উদ্যোগসমূহ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু উন্নয়নকৃত মাঠগুলোতে প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তিতার অভাবে এলাকাবাসী খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে মাঠ-পার্কের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে।</p> <p>ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারীর সভাপতিত্বে এবং সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার জিয়াউর রহমান সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইপিডি-এর পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এবং বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. শায়ের গফুর, এবং আইপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। </p> <p>ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বর্তমানে মাঠগুলোতে খেলার সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। বিদ্যালয়গুলোতেও খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে মাঠের স্বল্পতা রয়েছে। ফলে কিশোর গ্যাং ও মাদকের প্রকোপ বাড়ছে। সিটি কর্পোরেশনের আওতায় বিভিন্ন মাঠ উন্নয়ন করা হলেও শর্তাবলী জুড়ে দেওয়ার জন্য বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রবেশের সুযোগ হারিয়ে গেছে। এ অবস্থায় নগর এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক মেয়েদের খেলার সুযোগ রেখে পরিকল্পনামাফিক খেলার মাঠ তৈরি এবং এলাকাভিত্তিক চাহিদা বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এজন্য খেলার মাঠ-পার্ক-গণপরিসর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালার পাশাপাশি বিশেষায়িত কর্তৃপক্ষ তৈরি করা করা আবশ্যক। খেলার মাঠ এর উন্নয়ন প্রকল্পে কংক্রীট ও অপ্রয়োজনীয় স্থাপনার সংযোজন রোধ করে ব্যয়সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর ডিজাইন এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। স্বল্প ব্যয়ে ও আটপৌরে নকশায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকৃতিভিত্তিক নকশাকে প্রাধান্য দিয়ে খেলার মাঠ এর নকশা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।’ </p> <p>অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় ২৩৫টি খেলার মাঠ থাকলেও এর মধ্যে ১৪১টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। বিদ্যমান মাঠগুলোতে শিশু-কিশোরদের অবাধ প্রবেশ নেই। ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও একই অবস্থা। অথচ মহানগরী, বিভাগীয় এবং জেলা শহরসহ দেশের সব শহরাঞ্চলের খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, পার্ক এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ অনুযায়ী, মাস্টারপ্ল্যানে মাঠ-উদ্যান বা জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত থাকলে কোন অবস্থাতেই এর চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না। খেলার মাঠের স্বল্পতা বিবেচনায়, ঢাকা শহরের চারপাশে ১০০ কিলোমিটার নদীর পাড় এবং জলাশয়গুলোকে সামাজিকীকরণের স্থানে পরিণত করে ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা সম্ভব।’   </p> <p>ড. শায়ের গফুর বলেন, ‘খেলার মাঠ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরি। খেলার মাঠ সংকুচিত হয়ে যাওয়ার পিছনে ক্ষমতার অপব্যবহার দায়ী। খেলার মাঠ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে শিশু-কিশোররা বড় অংশীদার। তাদের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। খেলার মাঠ জনগণের একটি নাগরিক চাহিদা। নগরে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া যায় তাহলে এই নাগরিক চাহিদা পূরণে বরাদ্দ দেওয়া অসম্ভব কেন?’ </p> <p>ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘২০২১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১০৭৪০ টি স্কুলে কোন খেলার মাঠ নেই। তাহলে শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণের সুযোগ তৈরি ও মানসিক বিকাশ কিভাবে হবে? এজন্য মাদকের ব্যবহার ও অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। আপদকালীন সময়ে, যেমন- অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের সময় মানুষের আশ্রয় নেওয়ার কোনো জায়গা থাকছে না। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় মাঠ ছাড়া কোনো স্কুলের অনুমোদন না দেওয়া, কতটুকু দূরে দূরে মাঠ তৈরির চাহিদা রয়েছে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার দিক নির্দেশনা বিবেচনায় রাখা জরুরি।’</p> <p>গাউস পিয়ারী বলেন, ‘আমাদের নগর পরিকল্পনায় শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা নারীদের চাহিদার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এ শহর তৈরি হয়েছে সক্ষম পুরুষদের জন্য। আমরা শিশুদের শারীরিক মানসিক বিকাশকে গুরুত্ব দিচ্ছি না বরং খেলার মাঠগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণ করছি। মাঠের দখলরোধে সরকারের কঠোর অবস্থান জরুরি। সকল অংশীদারদের সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর গড়ে তুলতে হবে।’</p> <p>কর্মসূচিতে আরো বক্তব্য রাখেন সমাজকর্মী এবং তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক সৈয়দা রত্না, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ- এর পলিসি অফিসার তালুকদার রিফাত পাশা, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এম এ মান্নান মনির, শিশুদের মুক্ত বায়ুসেবন সংস্থার সদস্য মো. সেলিম, ডিডিপি’র সভাপতি জাকির হোসেন, রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তাহাজ্জোত হোসেন, ধানমণ্ডি কচিকণ্ঠ হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এইচএম নুরুল ইসলাম প্রমুখ।</p>