<p>আচরণ-বিজ্ঞানের আদি সূত্র হলো, মানুষের সঙ্গে কথোপকথন। সাধারণ সামাজিক জীবনেও মানুষ যদি মানুষের সঙ্গে কথা বলে, তাহলে অনেক ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হয় এবং অনেক অজানাকে জানা যায়। সামাজিক জীবনেও তাই যেমন কথোপকথনের প্রয়োজন আছে, ঠিক সেভাবেও এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনে সম্পর্ককে সুষ্ঠুভাবে বজায় রাখতে ভবিষ্যতে আরো দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগোতে ডায়ালগ হলো সবচেয়ে দামি মেকানিজম। সুতরাং সক্রেটিসের তৈরি করা এই পদ্ধতি আজ কূটনীতিতেও সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয়।</p> <p>গোটা পৃথিবীতে ভোটের পর্ব শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালটাকে তো বলা হচ্ছে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বছর। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও দামামা বাজতে শুরু করেছে। পাকিস্তানে ভোট। ইন্দোনেশিয়ায় ভোট। আরো কত দেশে ভোট। এরই মধ্যে ভারতেও নির্বাচন মে মাসে। তার আগে জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের নির্বাচনও দরজায় কড়া নাড়ছে।</p> <p>গোটা পৃথিবীতে যেখানেই নির্বাচন হোক না কেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ভারতের বিদেশনীতির জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর ঠিক বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ভারতে আসা, ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক নিশ্চয়ই নজর কাড়ে।</p> <p>শুক্রবার নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।</p> <p>যদিও এই বৈঠকে সাধারণভাবে জি ২০ থেকে শুরু করে তিস্তা চুক্তি, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনা ছাপিয়ে দুই পররাষ্ট্রসচিবের মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে যখন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাংশ নানাভাবে নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিয়ে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, সেই চেষ্টা বিফলে গেছে।</p> <p>কালের কণ্ঠ পত্রিকায় এই দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে কী কী আলোচনা হয়েছে, তার সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। সেই বর্ণনা থেকেও বোঝা যায়, কোনো বিষয়কেই সংবেদনশীল বলে আলোচনা থেকে বাইরে রাখা হয়নি। সব কিছু নিয়েই খুব খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।  <br /> বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিবরা বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং ২০২৩ সালে এ সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁরা দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্প্রতি কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধনের কথা উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্রসচিবরা বলেন, এ ধরনের সহযোগিতা শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাস্তবধর্মী ফলাফলের নিদর্শন।</p> <p>বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিবরা উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আঞ্চলিক সংযোগ, আঞ্চলিক বিদ্যুৎ গ্রিড সংযোগ, নিরাপত্তা ও পানি সংক্রান্ত সমস্যা, কনস্যুলার ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারে জোর দেন। তাঁরা এলডিসি উত্তরণ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও আলোচনা করেন। উভয় পক্ষই শান্তিপূর্ণ সীমান্ত এবং দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছে।</p> <p>পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন দ্রুত তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানিবণ্টন চুক্তি, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য পণ্য বাণিজ্যে বাধা দূর করা এবং দুই দেশের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেন।</p> <p>পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা প্রদান প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে অনুরোধ জানান। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তিনি ভারতের সহযোগিতা চান।</p> <p>ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা বাংলাদেশকে বিশ্বস্ত প্রতিবেশী হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদারে ভারতের নেতাদের অঙ্গীকারের কথা বৈঠকে তুলে ধরেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। তিনি এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর জোর দেন।</p> <p>কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনের আগে সম্ভবত এটিই দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের শেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন। আগামী এপ্রিল-মে মাসে ভারতেও নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে পররাষ্ট্রসচিবের এই সফরকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। বিশেষ করে গত ১০ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে বাইরের কারো হস্তক্ষেপ না করার ওপর জোর দিয়েছে।</p> <p>ভারত আর বাংলাদেশের এই সুসম্পর্ককে বজায় রাখার অনেক প্রতিবন্ধকতাও আছে। দুটি দেশেই দুটি দেশের বিরুদ্ধে একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও কায়েমি স্বার্থ কাজ করে। বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী কার্যকলাপ করার একটি কায়েমি স্বার্থ আছে। আবার ভারতেও বাংলাদেশের বিষয়ে পান থেকে চুন খসলেই রে রে করে ওঠার জন্য একটি বাহিনী কাজ করে।</p> <p>বাংলাদেশে খুব সামান্য কয়েকজন হয়তো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের বিশ্বকাপে ভারত পরাস্ত হওয়ায় সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতবিরোধী কিছু প্রচার চালালেও সঙ্গে সঙ্গে সেটা আমাদের দেশে ভাইরাল হয়ে যায়। সেটা বাংলাদেশবিরোধী একটা প্রচার হয়। এই বিরোধিতাটা শান্তিপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।</p> <p>প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাটা এটা দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। বাংলাদেশ ভারতের জন্য অনেক কিছু করেছে। শেখ হাসিনা সরকার সন্ত্রাস দমন থেকে শুরু করে, জঙ্গিদের ধরে দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে ভারতকে সাহায্য করেছে। আয়তনে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশের ভূমিকা কিন্তু ছোট নয়। কিন্তু ভারত কি সেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে করতে পেরেছে? এটা নিয়েও কিন্তু বিতর্ক হয়। স্থলসীমান্ত থেকে শুরু করে জি২০-তে আমন্ত্রণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক দৌত্য বাংলাদেশের জন্য, এগুলো যে রকম ভারত করে, ঠিক সেভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ যুক্তরাষ্ট্রীয় সমস্যায়, তিস্তা চুক্তি আজও হয়নি। কিন্তু ভারত এবারও পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ভারতের যে সদিচ্ছা এবং সেটার ব্যাপারে যে সচেষ্ট, সে কথা জানাতে ভোলেনি।<br /> এই ভারতের ভূমিকা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে। একটা ‘স্কুল অব থট’ আছে যে ভারত ইসরায়েল, হামাস, জি২০, সেন্ট্রাল এশিয়ার ইস্যু- এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়া বিবাদ, সেসব ব্যাপারে মধ্যস্থতাকারী হতে চাইছে। এর ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি যতটা নজর দেওয়া প্রয়োজন, ততটা দেওয়া হয় না। মিয়ানমার, মালদ্বীপ, নেপাল, এমনকি ভুটান পর্যন্ত নানা কারণে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে যাতে সম্পর্কের অবনতি না হয়, তার জন্য ভারতকে আরো অনেক বেশি কাঠখড় পোড়ানো উচিত ছিল। সেটা ভারত পোড়ায়নি। আবার এটা যেমন একটা ‘স্কুল অব থট’, অন্যদিকে রয়েছে যে ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কখনোই বাংলাদেশকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করে না। যেটা করার, সেটা করে।</p> <p>পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলছিলেন যে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও যদি আমরা ঝগড়া করি, তাহলে সেটা প্রকাশ্যে চিৎকার করে করার থেকে কিন্তু নিঃশব্দে কূটনীতিটা অনেক বেশি কার্যকর। কেননা তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইগো আহত হয় না। আবার কার্যসিদ্ধিও হয়। কেননা বোঝানোর মাধ্যমে একটা জিনিসকে কার্যসিদ্ধি করা আর সংঘাতের পথে গিয়ে বৈরিতা তৈরি করা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটা বৃহৎ রাষ্ট্র, সেটাও সুকূটনীতি নয়। এখন এই বিতর্কে বাংলাদেশে ভোটের আগে হাসিনাবিরোধী শক্তি, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত ভারতবিরোধী তাসটাকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে আসতে চায়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা ভারতবিরোধী অসন্তোষ উসকে দিয়ে ভোটের সময় কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার ভারতের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে আমরা শেখ হাসিনাকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অভিন্ন বিদেশনীতির প্রশ্নে সমর্থন করি। ওদিকে শেখ হাসিনার গভর্ন্যান্স নিয়ে প্রশ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুলেছে।</p> <p>এটা তো এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ভোট হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের একাংশ আর বাংলাদেশের একটা গোষ্ঠী চাইলেও সেটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে বিএনপির ভোট বয়কটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ভোটের আগে যাতে কোনো রকমভাবেই সন্ত্রাস, হামলার পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেটাই ভারতের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের এই অস্থিরতাকে নির্মূল করার জন্য শেখ হাসিনা আগামী দিনে আবার ক্ষমতাসীন হয়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এমনটা ভারতের আশা।</p> <p>লেখক : <strong>নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</strong></p>