<p>শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ দাবি করে মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চার আসামি।</p> <p>আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে এ আরজি জানান তারা। পরে আদালত যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনের জন্য আগামী ১৬ নভেম্বর তারিখ রাখেন।</p> <p>আদালতে ড. ইউনূসসহ চার আসমির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন, আইনজীবী আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান ও আইনজীবী সৈয়দ হাসান আলী।</p> <p>পরে ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। আগামী ১৬ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ রেখেছেন আদালত।’</p> <p>সাফাই সাক্ষী না নেওয়ার বিষয়ে এ আইনজীবী বলেন, ‘অপরাধ বা অভিযোগ প্রমাণ করার দায়িত্ব বাদী পক্ষের। বিবাদী পক্ষের না। যে কারণে সাফাই সাক্ষী নেওয়া হয়নি।’</p> <p>অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ মামলার অভিযোগ গঠনের পর তা বাতিল চেয়ে আসামিরা হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। হাইকোর্ট তাদের আবেদন খারিজ করে বলে দিয়েছেন, অভিযোগে যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে, সেসব অপরাধ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটি নির্ণয় করবে। আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট থেকে তাদের আবেদন খারিজ হওয়ার পর এখন বিচার চলছে।’</p> <p>এ আইনজীবী বলেন, ‘এ মামলাটি হচ্ছে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা। এ অভিযোগ পাশ কাটিয়ে উনারা (আসামিরা) বলেছেন, তারা যা করেছেন কোম্পানি আইন অনুযায়ী করেছেন। তাছাড়া আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা সাক্ষীদের জেরার ভিত্তিতে। সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কোনো বক্তব্য নেই সেখানে।’</p> <p>এর আগে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুসারে এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দুপুর ১২টার দিকে আদালতে আসেন ড. ইউনূস। আদালতের কার্যক্রম শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি যে সমস্ত উদ্যোগ নিয়েছি, তার কোনোটাতেই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নেইনি। সেটা গ্রামীণ ব্যাংক হোক বা সেটা অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠান হোক।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে লাভ করবে, মুনাফা করবে, বড় করবে বলে। আমরাও লাভ করেছি, বড় করেছি। কিন্তু আমাদের যেটা মূল লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক ব্যবসা। ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের উপকার। এখানে (সামাজিক ব্যবসার প্রতিষ্ঠান) যিনি বিনিয়োগ করবেন তিনি কোনো মুনাফা নেবেন না। আমি এই সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা। বিশ্বব্যাপী এটা প্রচার করার চেষ্টা করছি। আমি নিজে যদি এর উল্টা করি তাহলে তো আর হলো না।’</p> <p>ব্যক্তিগতভাবে মুনাফা করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গী যারা আছে তাদেরও। তারপরও বিচারের বিষয়টা এসেছে। কেন এসেছে সেটা আপনারাই বিচার করবেন। আমাদের উদ্দেশ্য, আদর্শ, কর্মসূচি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া, মালিক হওয়ার জন্য না।’</p> <p>এক প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘মানুষ তো আর ফেরেস্তা না, অসাবধানতাবশত কিছু ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। মানুষ ভুল করতেই পারে। যেকোনো একটা কাজ করতে গেলে ভুলভ্রান্তি তো হবেই। ভুলভ্রান্তি এক জিনিস, অপরাধ আরেক জিনিস।’</p> <p>আত্মপক্ষ সমর্থনে যা বলা হয়েছে মামলায় আনা অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপূর্ণ দাবি করে তা প্রত্যাখ্যান করেন ড. ইউনূসসহ চার আসামি। তাঁরা মামলা খারিজের আরজি জানান আদালতের কাছে।</p> <p>শ্রম আইনের ৪(৭)(৮) ধারা অনুসারে প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার পরও চাকরি স্থায়ী করা হয়নি বলে যে অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়, সে অভিযোগ খণ্ডন করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। কারণ গ্রামীণ টেলিকম যেসব ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে সেগুলো চুক্তিভিত্তিক এবং মেয়াদ শেষে তা নবায়ন করা হয়। যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে তাই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।</p> <p>তাছাড়া শ্রম আইনের ৪(৮) ধারায় বলা আছে, শিক্ষানবিশকাল শেষে বা তিন মাস মেয়াদ বাড়ানোর পরও স্থায়ী না করা হলে আইনের ৪(৭) ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শ্রমিক স্থায়ী বলে গণ্য হবে। আসামিদের বক্তব্য হচ্ছে, শ্রম আইনের মধ্যেই আইন লঙ্ঘনের প্রতিকার দেওয়া আছে। ফলে কোনোভাবেই এটি অপরাধ না। শ্রম আইন অনুসারে এটি প্রশাসনিক ও দেওয়ানী মামলার বিষয়।</p> <p>শ্রম আইনের ১১৭ ধারা অনুসারে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ না দেওয়ার অভিযোগও খণ্ডন করা হয় বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে। এ বিষয়ে তাদের যুক্তি হচ্ছে- শ্রম আইনের ৩(১) ধারা অনুসারে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা থাকতে পারে। গ্রামীণ টেলিকম ২০০২ সালে অর্জিত ছুটি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করে, যা ভূতাপেক্ষভাবে ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। যদিও শ্রম আইন হয় ২০০৬ সালে।</p> <p>গ্রামীণ টেলিকমের নীতিমালায় বছরের ৩০ দিন অর্জিত ছুটির বিধান রাখা হয়েছে। শ্রম আইনে প্রতি ১৮ কর্মদিবসের জন্য ১ দিন ছুটি রাখা হয়েছে। সে হিসেবে বছরে ১৪দিন অর্জিত ছুটি পায় শ্রমিক-কর্মচারীরা। গ্রামীণ টেলিকমের নীতিমালায় শ্রম আইনের চেয়ে বেশি অর্জিত ছুটির বিধান রাখা হয়েছে।</p> <p>এছাড়া গ্রামীণ টেলিকমের অর্জিত ছুটি নগদায়নের ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীরা প্রতি ৩ বছরে ৩০ দিনের ছুটি নগদায়ন করতে পারবে এবং ৬০ দিন ছুটি জমা রাখতে পারে। অন্যদিকে শ্রম আইনে ১৪ দিনের অর্জিত ছুটির মধ্যে প্রতি বছর ৭ দিনের ছুটি নগদায়ন করা হয়। বাকি ৭ দিনের ছুটি জমা থাকে। গ্রামীণ টেলিকমের নীতিমালা অনুসারে কর্মকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারীরা বছরে ১০ দিনের অর্জিত ছুটি নগদায়ন করতে পারে, যা শ্রম আইনের বিধানের চাইতে তিনদিন বেশি।</p> <p>শ্রমিক অংশগ্রহণ ও কল্যাণ তহবিল গঠন এবং নিট মুনাফার ৫ শতাংশ তহবিলে না দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়, কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুসারে গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে এর মুনাফা বা লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়। যে কারণে শ্রমিক অংশগ্রহণ ও কল্যাণ তহবিলে নিট মুনাফার ৫ শতাংশ দেওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন তহবিলের ৫ শতাংশ দাবি করে শ্রম আদালতে মামলা করে। এ বিষয়ে মামলা বিচারাধীন। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেব।</p> <p>ড. ইউনূসসহ বিবাদীরা আত্মপক্ষ সমর্থনের লিখিত বক্তব্যে বলেন, শ্রম আইনের ২৩৪ ধারার বিধান প্রতিপালন না করলে ২৩৬ ধারায় প্রতিকারের বিধান রাখা হয়েছে। শ্রম আইনের ২৩৬ ধারার বিধান প্রতিপালন না করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কখনো গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করতে পারে না। মূলত ড. ইউনূসসহ চার বিবাদীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইনের ৪(৭)(৮), ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা প্রশাসনিক ও দেওয়ানী প্রকৃতির। তাছাড়া এ মামলার বাদীসহ রাষ্ট্রপক্ষের ৪ জন সাক্ষী আদালতে মিথ্যা ও অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন, যা জেরায় প্রমাণিত হয়েছে। অতএব, বিনীত প্রার্থনা এই যে, ন্যায় বিচারের স্বার্থে এই মিথ্যা অভিযোগ থেকে আমাদের অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানাচ্ছি।</p> <p>মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে তারা শ্রম আইনের লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে পারেন। এর মধ্যে ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি। শ্রমিকদের অংশগ্রহণের তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।</p> <p>এ মামলার অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ড. ইউনূস হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্ট সে আবেদন খারিজ করার পর আপিল বিভাগ সে খারিজ আদেশ বহাল রাখেন। পরে বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানার আদালতে গত ২২ আগস্ট থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। কলকারকানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চার পরিদর্শক এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। </p>