স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশকে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির (রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, দুর্নীতি ইত্যাদি) পাশাপাশি বৈশ্বিক নানা ধরনের ঝুঁকি (বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, মহামারি, আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিরতা, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি) মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ অনেক ঝুঁকির মধ্যে বর্তমান করোনা মহামারি, দুর্নীতি ও পণ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা থেকে উত্তরণের পথ সরকার এখনো বের করতে পারেনি। গত দুই দশকে বহির্বিশ্ব থেকে প্রথম ধাক্কা আসে যখন মাল্টিফাইবার অ্যাগ্রিমেন্টের আওতায় পোশাক রপ্তানিতে কোটা সুবিধা উঠে যায়।
বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয় ধাক্কাটি আসে ২০০৮ সালে, যখন সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। পৃথিবীর বড় বড় অর্থনীতির দেশ যখন মন্দা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছিল, তখনো বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দার আঘাত থেকে নিজেকে অনেকটাই রক্ষা করতে পেরেছে সরকারের কার্যকর আর্থিক ও রাজস্ব নীতি গ্রহণ করার কারণে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত সারতে না সারতেই চলে আসে মহামারি করোনার আঘাত। বর্তমান সরকার শক্ত হাতেই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক আঘাত আসে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ, যা জ্বালানি তেলের সরবরাহকে শুধু বিঘ্নিতই করেনি, দাম বাড়িয়েছে অনেক। জ্বালানি তেলের অস্থিতিশীল বাজার, করোনাকালে উৎপাদন কমে যাওয়া এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে দ্রুত চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম আজ আকাশছোঁয়া। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সমস্যায় পড়েছে। আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলো প্রণোদনা বন্ধ করে এবং ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টা করছে। একের পর এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অভিঘাত মোকাবেলা করা দেখে যে কেউ বলতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক খাত ভালো করছে (যেমন—পোশাক খাত, কৃষি খাত ও ওষুধশিল্প)। অন্যদিকে দুর্বল বা ভঙ্গুর খাতের সংখ্যাও কম নয়। শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাতে আর্থিক কেলেঙ্কারি, স্বাস্থ্য খাত ও মেগাপ্রকল্পে দুর্নীতি, মেগাপ্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা, অপ্রয়োজনীয় বা অলাভজনক প্রকল্প নির্বাচন, বেকারত্ব, খাদ্য মজুদ হ্রাস, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি সমস্যা হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের মতো নবীন ও দ্রুত বর্ধনশীল দেশের জন্য বাড়তি সতর্কতা, সঠিক ও আগাম পরিকল্পনা ও পরিচর্যা দরকার। তা না হলে কঠিন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এক খাতের ওপর অধিক নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞ দ্বারা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, এমন অভিযোগ আছে। জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর। বর্তমান সংকট মোকাবেলায় সরকারকে কিছু বিষয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের সম্পন্ন হওয়া ও চলমান বেশির ভাগ প্রকল্প অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সুফল বয়ে আনবে। তবে সরকারের উচিত হবে সবে শুরু হয়েছে বা শুরু হতে যাওয়া মেগাপ্রকল্পগুলো পুনরায় মূল্যায়ন করা এবং অলাভজনক ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া। রেললাইন তৈরির ক্ষেত্রে যেখানে-সেখানে রেললাইন তৈরি না করে সবার আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-রংপুর রেললাইনগুলো ডাবল লাইনে উন্নীত করা জরুরি। সপ্তাহে অন্তত দুটি ট্রেন যাতে বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
কৃষি খাতকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ কৃষি খাত ভালো ছিল বলে আমরা সব চ্যালেঞ্জ বা বিপদ সফলভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন দ্রুত হারে কমে যাচ্ছে। কৃষিজমিতে শিল্প-কারখানা বা অন্যান্য স্থাপনা তৈরিতে কঠোর নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ভালো করছে, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের মান ও দাম চীন, ভিয়েতনাম বা কলম্বিয়া থেকে কম। পোশাকের মান বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে। রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে শুধু পোশাকের ওপর নির্ভরশীল না থেকে ওষুধ, হালকা যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক ও কৃষি পণ্য (শাক-সবজি, আলু, মাছ, আম, লিচু ইত্যাদি) রপ্তানির জন্য নগদ সহায়তাসহ নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক ও আইটি পার্কগুলোকে পুরোপুরি উৎপাদনে এনে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বেকার যুবসমাজের মধ্য থেকে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন নতুন ব্যবসা বা উৎপাদন পরিকল্পনা বাছাইয়ের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণসহ অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার ফলাফল সরকার পেতে শুরু করেছে। তবে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা আরো বাড়াতে হবে।
জ্বালানি তেল হচ্ছে মানবশরীরের রক্তের মতো। প্রবাহ ভালো থাকলে উৎপাদনপ্রক্রিয়া ভালো চলে। তবে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য উৎপাদন খরচ বাড়ানোর পাশাপাশি জনজীবন অস্থির করে তোলে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে দেশের অভ্যন্তরে দাম একবারে না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ালে বা সমন্বয় করলে জনগণের দুর্ভোগ কমবে বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের হয়তো কিছুটা খরচ বাড়বে, কিন্তু জনগণ ও অর্থনীতির মঙ্গল হবে।
সর্বোপরি শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাতে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, ব্যাংক মালিক ও সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাতের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য এবং আর্থিক সংকটকালে ধনী লোকের ভোগ ব্যয় কমানোর জন্য বিলাসবহুল পণ্যদ্রব্যে আমদানির ওপর উচ্চ আমদানি কর আরোপ করতে হবে। করোনা যেহেতু সহনীয় হয়ে এসেছে এবং কর্মব্যস্ততা যেহেতু প্রায় ফিরে এসেছে, সেহেতু আগামী অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ওপরের দিকে করহার বাড়াতে হবে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা কমবে, আবার উচ্চ আয়ের মানুষ বেশি কর প্রদান করবে।
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে না, আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।
লেখক : পিএইচডি ফেলো, মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউফাউন্ডল্যান্ড, কানাডা এবং সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়