স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে যেসব সূচক অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশ সেগুলো অর্জন করেছে। এক বছর আগেও নির্ধারিত ছিল যে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণ দুই বছর পিছিয়ে গেছে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলেও বাংলাদেশ আরো তিন বছর এলডিসির সুবিধা অব্যাহত রাখতে চায়। এমন প্রেক্ষাপটে এসব সূচকের মান ধরে রাখতে রাজস্ব আয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ শতাংশে উন্নীত করতেই হবে। এ জন্য প্রতিবছর রাজস্ব আহরণ জিডিপির ১ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েই চলেছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই আগামী অর্থবছরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে তিন লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এটি জিডিপির ১০.৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
রাজস্ব আহরণে গতানুগতিক পরিকল্পনা রাজস্ব আয় জিডিপির ১৫ শতাংশে উন্নীত করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, যেভাবেই হোক রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রাজস্ব আয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। রাজস্ব আহরণে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্নে অবস্থান করছি। আমাদের অবশ্যই রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। যারা কর দেয় না তাদের করের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য গ্রামসহ সব জায়গায় করজাল বাড়াতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা বরাবরের মতোই পিছিয়ে থাকব।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে যে সূচকগুলোর প্রয়োজন, সেগুলোতে আমরা ভালো অবস্থানে আছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য মূলত তিনটি সূচকের যেকোনো দুটিতে ভালো করলেই হয়। এই সূচকগুলো হচ্ছে মাথাপিছু আয় এক হাজার ২২২ ডলার, মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্টের বেশি এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা কম। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু আয় এক হাজার ৮২৭ ডলার, মানবসম্পদ সূচক ৭২.৪ এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ২৭ পয়েন্ট রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, সব সূচকের মানের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে রাজস্ব আয় জিডিপির ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে স্বীকার করেছে।
বাংলাদেশ গত ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) পর্যালোচনায় প্রথমবারের মতো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সব মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হয়েছিল। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেতে নিয়ম হলো প্রথম মূল্যায়নে সূচকগুলোর মান অর্জন হলে পরের তিন বছর একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এর পরের মূল্যায়নেও মান অর্জন করলে চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়। আসছে ফেব্রুয়ারিতে সিডিপি এই সুপারিশটি করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ।
সিডিপির প্রবিধান অনুযায়ী উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভের পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতিকালীন সময় ভোগ করতে পারে। আগামী মাসে সিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় উত্তরণের এই সুপারিশ লাভের পর পাঁচ বছর প্রস্তুতিকাল শেষে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে ২০২৬ সালে।
এ মাসের শুরুতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক উত্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য রাজস্ব আয় জিডিপির ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে হলে প্রতিবছর জিডিপির ১ শতাংশ হারে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৭ হাজার ৯২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৯৫৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ২৫ হাজার ৮৬৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত অর্থবছর একই সময় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আগামী অর্থবছরের (২০২১-২২) জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয় বাড়াতে আগামী বাজেটে যেসব খাত থেকে রাজস্ব আদায় করার পরিকল্পনা হচ্ছে তাতে নতুন কোন খাত নেই। তাই বাস্তবে পরিস্থিতি কতটা উন্নতি হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলনেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হওয়ার কথা ৪ লাখ ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ধরা হয়েছে। রাজস্ব পরিকল্পনায় এসব পার্থক্য দূর করার পাশাপাশি রাজস্ব আয় না বাড়ালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
মন্তব্য