নতুন এক ভাইরাস, যাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নাম দিয়েছে কভিড-১৯। সারা পৃথিবীকে এটি কাঁপিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন তিন লাখের মতো আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে গড়ে পাঁচ হাজারের মতো।
এর আগেও ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সার্স ভাইরাস, ব্রাজিল ও লাইবেরিয়ায় নিপাহ ভাইরাস এবং চীনের সোয়াইন ফ্লু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে ওগুলো বেশি ছড়ায়নি। ভারত ও ব্রাজিলে সোয়াইন ফ্লু দেখা দিলে তা দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে এসেছে; যদিও প্রতিষেধক টিকা আসতে বেশ সময় লেগেছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ তথা কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা বেশ কাজে দিয়েছিল সে সময়। কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে চিত্র সম্পূর্ণই আলাদা। মাত্র দু-তিন মাসের মধ্যে এটি সারা বিশ্বের প্রায় ২১৪টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এতই ছোঁয়াচে ও মারাত্মক এটি! এর কাছে জ্ঞান-বিজ্ঞান সব অসহায় হয়ে পড়ে। প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। চেষ্টা চলছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সর্বত্রই চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা টিকা আবিষ্কারের। কোনো কোনো দেশ অনেক দূর এগিয়েছেও এ ক্ষেত্রে। চীন তো তার প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে অন্তত দুটি টিকার প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে। সফল হলে অন্যান্য দেশও পাবে। রাশিয়াও অন্তত দুটি টিকার প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে। আপাতত রাশিয়ায় সফল হলে হয়তো তারাও অন্যান্য দেশকে দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারত, এমনকি আমাদের দেশও এ ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই হয়তো বিশ্ববাসী কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক টিকা পেয়ে যাবে। কাজেই যত দিন টিকা না আসবে, তত দিন উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই মহামারি আমাদের অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
আসলে যেকোনো রোগব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উন্নত ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে মুখ্য অস্ত্র। কোনো দেশই কভিড-১৯-এর আগমন সম্পর্কে জানত না, প্রস্তুতও ছিল না। চীনে প্রথম আক্রমণ করলেও সেখানকার সরকারের কঠোর ও বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যবিধি এবং কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফলে উহানের বাইরে ভাইরাসটি ছড়াতে পারেনি। একপর্যায়ে চীন সরকার উহান শহরকে পরিপূর্ণভাবে লকডাউন করে দেয়। একই সময়ে তারা চীনের অন্যান্য শহর থেকে হাজার হাজার ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী উহানে নিয়ে আসে। এসব ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে রোগীদের সুস্থ করে তোলেন। চিকিৎসাযন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা করে চীন সরকার। মোট কথা, সর্বশক্তি নিয়ে ভাইরাস নির্মূলে নেমে পড়ে সরকার ও জনগণ। জনগণও সরকারের ডাকে সাড়া দেয় এবং সরকার কর্তৃক জারীকৃত পরামর্শ ও নির্দেশাবলি মেনে চলে। ফলে সেখানে ভাইরাসটি উহানের বাইরে ছড়াতে পারেনি। মৃতের সংখ্যাও তুলনামূলক কম ছিল (চার হাজার ৬৩৪ জন)। মার্চের পর আর চীনে কেউ মারা যায়নি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য রাজধানী বেইজিংয়ের একটি এলাকায় কিছু সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এটা আমদানীকৃত খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে হিমায়িত মাংসের চালানের মাধ্যমে এসেছিল ব্রাজিল থেকে। চীনারা এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দিয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে চীন সরকারের কঠোর ও সর্বব্যাপী পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে। মনে রাখতে হবে, চীন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সেখানে গোটা দেশ, দেশের মানুষ ও অর্থনীতির ওপর সরকারের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে বিধায় এটা সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সফল আরেকটি দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম। এ দেশটিও সমাজতান্ত্রিক দেশ। উল্লেখ্য, চীনের সঙ্গে এ দেশটির রয়েছে বিশাল সীমান্ত। শুধু তা-ই নয়, ভিয়েতনামের অসংখ্য শ্রমিক চীনের উহানে কাজ করত। কভিড-১৯ সংক্রমণের সময় তারা সেখানেই ছিল। সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সব শ্রমিক দেশে ফিরে আসে। তবে ভিয়েতনাম সরকার তাদের কোয়ারেন্টিনে পাঠায় এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুই সপ্তাহ পর বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেয়। ফলে কভিড-১৯ ওই দেশে ছড়াতে পারেনি এবং একজনও মারা যায়নি। কিউবা ও বেলারুশের ঘটনাও প্রায় এ রকম। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বাইরে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল দেশের নাম হচ্ছে নিউজিল্যান্ড। কিছু সংক্রমণ হলেও গত মার্চ থেকে দেশটি কভিড-১৯ মুক্ত। সেখানেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ব্যবসা-বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে; এমনকি জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত হয়ে গেল গত ১৭ অক্টোবর। কভিড-১৯ মুক্ত করতে পারায় প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছেন। সফল প্রধানমন্ত্রীকে জনগণ যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেছে।
যেসব দেশ কভিড-১৯-কে অবহেলা করেছে, হেলাফেলা করেছে, তাদের এর মাসুল গুনতে হয়েছে। এই দেশগুলোর শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল। ভারত প্রথম দিকে কিছুটা পথে থাকলেও মাঝপথে সব কিছু খুলে দিয়ে চরম মাসুল দিচ্ছে (সংক্রমণও সবচেয়ে বেশি, মৃত্যুও সবচেয়ে বেশি)। আমাদের দেশে সরকার অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে; যদিও এ ক্ষেত্রে অনেকটা সময়ক্ষেপণ হয়েছে। সমস্যা ছিল বাস্তবায়ন পর্যায়ে। কোনো সমন্বয়ই ছিল না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরের সমন্বয়হীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কঠোরভাবে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন (স্বাস্থ্যবিধিসহ) মেনে চলতে পারলে আমরা হয়তো বিপর্যয় এড়াতে পারতাম। আরেকটি কথা, কভিডকে উপলক্ষ করে স্বাস্থ্য খাতের চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির যে চিত্র আমাদের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়েছে, তার একটা বিহিত করতেই হবে। কঠোর আইন করতে হবে এবং ছোট-বড় (রাঘব বোয়ালসহ) প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে, অন্যথায় সরকারের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। জনগণ বঞ্চিত হবে প্রয়োজনীয় সেবা থেকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে নাকি ১৫ লাখের মতো ভাইরাস রয়েছে। কভিড-১৯ তার মধ্যে একটি মাত্র। কভিড-১৯-এর চেয়ে ভয়ংকর ভাইরাস এদের মধ্যে থাকতেই পারে। কাজেই বর্তমানের কভিড-১৯ মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আরো ভয়ানক কিছুর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশের গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা সম্পর্কে সব নাগরিককে ধারণা দিতে হবে, সচেতন করতে হবে। পর্যায়ক্রমে এগুলো পাঠ্যসূচিতে (বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায়) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, কার্যনির্বাহক কমিটি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
মন্তব্য