শেষ হয়েছে অপেক্ষার। বেক্সিমকো ঢাকা, মিনিস্টার রাজশাহী, ফরচুন বরিশাল, জেমকন খুলনা ও গাজী গ্রুপ চট্টগ্রাম এই পাঁচটি দল নিয়ে শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ ২০২০। এই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিদেশি ক্রিকেটার নেই। এটি দেশের তরুণ ক্রিকেটারদের নিজেকে তুলে ধরা, যোগ্যতা প্রমাণ এবং নিজেকে চেনানোর বড় একটি সুযোগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে স্মরণীয় ও স্মৃতিময় করে রাখার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এটি বিশেষ আয়োজন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে একজন ক্রীড়ানুরাগী ও ক্রীড়াপ্রেমিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন একপর্যায়ে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ঘিরে সংকটের জন্ম হয়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধু এই খেলাকে প্রটেকশন দিয়েছেন। খেলা, ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংগঠকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, ‘এ দেশে আগেও ক্রিকেট ছিল, ক্রিকেট থাকবে।’ বঙ্গবন্ধুর ত্বরিত ব্যবস্থায় ক্রিকেটের আকাশ থেকে মেঘ কেটে গেছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেটে তরুণদের সম্ভাবনা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ক্রিকেটের সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একসময় ক্রিকেট বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত করবে। জাতির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। ২০০০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট পরিবারের গর্বিত সদস্য হয়। এরপর ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক। এর আগে পাকিস্তানের দিনগুলোতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে একজনও বাঙালি ক্রিকেটার টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। অভিষেক টেস্টে প্রধান অতিথি হিসেবে মাঠে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি। শেখ হাসিনা নিজেও একজন ক্রীড়াপিপাসু। এরপরের ক্রিকেট ইতিহাস তো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অজানা নয়। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশে শুধু একটি খেলা নয়—এর চেয়ে বেশি কিছু।
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট শুরুর আগে দলের অধিনায়করা বলেছেন, তাঁরা জমজমাট ও প্রাণবন্ত ক্রিকেট উপহার দেবেন। উদ্বোধনী দিনে সেই ক্রিকেট দেখেছি। দুটি ম্যাচে (বেক্সিমকো ঢাকা ও মিনিস্টার রাজশাহী এবং ফরচুন বরিশাল ও জেমকন খুলনা) টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দারুণ দুটি বিজ্ঞাপন দেখার সুযোগ হয়েছে। রোমাঞ্চ আর টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হয়েছে অসাধারণ দুটি ম্যাচ। আর এটাই ক্রিকেট। ক্রিকেটের লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। দুটি খেলাতেই শেষ ওভারে খেলার রং আর মাঠের ছবি পাল্টে গেছে। ওলটপালট হয়ে গেছে অনুধ্যান। অগ্রহায়ণের দুপুর থেকে বিকেল, এরপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পর্যন্ত অপরূপ ক্রিকেট। বসুন্ধরা গ্রুপের ‘টি স্পোর্টস’ আগামী ১৮ ডিসেম্বর ফাইনাল পর্যন্ত টুর্নামেন্টটি সরাসরি সম্প্রচার করবে।
উদ্বোধনী দিনে দুটি ম্যাচেই তারুণ্যের জয়জয়কার। তাঁদের আত্মবিশ্বাস, সাহস, বুদ্ধিদীপ্ত ক্রিকেট, দায়িত্ববোধ, সচেতনতা ক্রিকেটকে রাঙিয়েছে। এর পরও ভুলত্রুটি ছিল, সেগুলো শুদ্ধ হলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রং আরো গাঢ় হবে। ফিটনেস আর ত্বরিত ফিল্ডিং এই ক্রিকেটে অন্যতম বড় একটি চাহিদা। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম ‘কম্প্রোমাইজের’ সুযোগ নেই। কিছু রান করার পর মেজাজ হারালে চলবে না। ধৈর্য ধরে হিসাব কষেই খেলতে হবে। ভালো ‘পার্টনারশিপ’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘সেট ব্যাটসম্যান’ মনঃসংযোগ নষ্ট করে আউট হওয়া মানেই হঠাৎ করে বড় ধাক্কা। অবশ্যই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কখনো কখনো একজন ব্যাটসম্যান বা একজন বোলার খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। তবে দলের কিন্তু বেশির ভাগ সময় জয় আসে সবার ‘পার্টিসিপেশনে’। টি-টোয়েন্টি হলো তাঁদের ক্রিকেট, যাঁরা ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পারেন। সঠিক মানসিকতায় আর চাপের মধ্যেই তো পারফরম করতে হয়। এক-দুই ওভারে রং বদলে যায়। একটি ভুল বা কিছু এদিক-সেদিক হলেই ম্যাচের ভাগ্য ঘুরে যায়। মাত্র ১২০ বলের খেলা। বোলারদের অনেক বেশি দায়িত্ব। ডটবল, রান চেক আর উইকেট! সব কিছুই দরকার।
আমাদের বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ থেকে দেশের ক্রিকেট বিশেষ করে এই সংস্করণ অনেক বেশি উপকৃত হবে। তরুণরা এই ক্রিকেটে ভালো করবেন। শুধু তাঁদেরকে মনঃসংযোগের মাধ্যমে এই ক্রিকেটে অভ্যস্ত হতে হবে। টি-টোয়েন্টি মোটেই ধুমধাড়াক্কার খেলা নয়। এটা মাথা খাটানোর খেলা। মাথা ঘামানোর খেলা। আমার মনে হয়, এখন টি-টোয়েন্টিতে এমন কিছু প্রতিভাসম্পন্ন, আত্মবিশ্বাসী ও সামর্থ্যের অধিকারী ক্রিকেটার এসেছেন যাঁরা অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কিছু পরিচিত মুখের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবেন। দিনশেষে মাঠের পারফরম্যান্সটাই আসল।
সাকিব আল হাসান এক বছর পর আবার ক্রিকেটে ফিরে এসেছেন। নতুন করে শুরু করেছেন। এটি দেশের ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় বিষয়। সাকিব বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে জেমকন খুলনা দলে। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাহমুদ উল্লাহ। সাকিব সব সময়ই ক্রিকেটে বড় অনুপ্রেরণা ক্রিকেটারদের জন্য। সাকিব এক বছর ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন। আশা করব, অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আবার ছন্দে ফিরে আসবেন। তবে আশার কথা চলতি অনূর্ধ্ব ১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমে জিতেছে খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬ উইকেটে পরাজিত করে সুপার এইটে স্থান করে নিয়েছিল। এরপর আর একটি ম্যাচেও জিততে পারেনি। কারণ হলো সঠিক মাইন্ড সেটে ঘাটতি, আবেগ আর ক্রিকেটে অনভ্যস্ততা।
ক্রিকেট বোর্ড অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করে পুরোপুরি স্বাস্থ্য প্রটোকল মেনে মাঠে ক্রিকেট এনেছে। বোর্ড ধীরে ধীরে দৃঢ়তাসহকারে এগিয়েছে। গত মাসে প্রেসিডেন্ট কাপ (তিন দল নিয়ে) ভালোভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হওয়ায় বোর্ডের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এরপর অনেক বড় আকারে জৈব সুরক্ষাবলয় তৈরি করে শুরু করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ। এই টুর্নামেন্ট সাকসেস মানেই বড় হার্ডলস অতিক্রম। এরপর তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসছে আগামী বছর জানুয়ারির ৭ তারিখে। তারা খেলবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। যতদূর জানি দুজন পর্যবেক্ষক আসার কথা স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য।
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি অনুষ্ঠিত হচ্ছে শুধু মিরপুরে। একই মাঠে খেলা। উইকেটের ওপর অনেক বেশি প্রেসার। কিছুই করার নেই। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই ন্যাড়া উইকেট। আর তাহলেই খেলা জমবে। আশা করব, বোর্ড উইকেটের বিষয়টাকে সাধ্যমতো গুরুত্ব দেবে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক
মন্তব্য