আমরা অনেক দিন থেকেই বলে আসছি, শেয়ারবাজারের মূল সমস্যাটা হচ্ছে ভালো শেয়ারের অভাব। ভালো শেয়ার হলো, যা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ উপযোগী শেয়ার। এমনিতে বাজারে অনেক শেয়ার আছে। কয়েকটি ছাড়া বাদবাকি সব শুধু জুয়া খেলার উপযুক্ত, যেগুলোতে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করার মতো কোনো অবস্থাই নেই। দেখা যায়, কিছুদিন পর পর ভালো শেয়ার আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে কিছু হয় না। ভালো শেয়ার আনতে বিভিন্ন সময় সরকারের নীতিনির্ধারকরা চেষ্টা করছেন; কিন্তু সাফল্য আসেনি। কিন্তু কেন আসেনি, তা কেউ খতিয়ে দেখেন না। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগের কথা ভাবা দরকার।
শেয়ারবাজারে টেক্সটাইল খাতের অনেক কম্পানি আছে, যাদের শেয়ার দুই-এক বছর ভালো ছিল। এখন তাদের ডিভিডেন্ট এত কমে গেছে যে শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী ওই সব শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান যদি দেখা যায়, আগে যেসব শেয়ারের দাম ৩০-৪০ টাকা ছিল, সেগুলোর দাম এখন ১০-১১ টাকা। আরো নিচেও এসে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, প্রথমত ওরা ভুল তথ্য দিয়ে বাজারে এসেছিল; দ্বিতীয়ত উদ্যোক্তাদের শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেওয়ার পর তাদের ডিভিডেন্ট দেওয়ার কোনো গরজ ছিল না। অথচ তারা ঠিকই কম্পানিগুলো চালাচ্ছে এবং ম্যানেজমেন্টেও বসে আছে। বেশ কিছু কম্পানির শেয়ার ধারণ ৩০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। অথচ তারা যখন শেয়ারগুলো ছেড়েছিল, তখন তাদের শেয়ার ধারণ ছিল ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। তারা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছিল। পরে শেয়ারগুলো বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা মার্কেট থেকে তুলে নিয়ে গেছে। এখন সেগুলো তাদের ব্যক্তিগত টাকা হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে উদ্যোক্তারা কম্পানিগুলোকে ‘আর্নিং পার শেয়ার’ কম দেখিয়েছে এবং ‘ডিভিডেন্ট রেট’ও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে শেয়ারের দাম কমতে কমতে এগুলো ‘পার ভ্যালু’র কাছে এসে গেছে অথবা ‘পার ভ্যালু’ থেকেও কমে গেছে।
এই কারণে লোকসানে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গত পাঁচ-ছয় বছরে কোনো অর্থ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেটে যায়নি। তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। চোখের সামনে দিয়ে উদ্যোক্তারা শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউ যদি একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন বা গবেষণা করেন, তাহলে দেখা যাবে শেয়ারহোল্ডিংয়ের সঙ্গে ডিভিডেন্ট প্রদানের একটা সম্পর্ক আছে। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই যেখানে শেয়ারহোল্ডিং বেশি, সেখানে ডিভিডেন্ট ভালো দিচ্ছে। যেখানে শেয়ারহোল্ডিং ৩০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে, সেখানে ডিভিডেন্ট কমিয়ে দিয়েছে। এর দুটি প্রভাব রয়েছে। একটা হলো, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ঠকেছে। আরেকটা হলো, সরকারকে ট্যাক্স কম দিচ্ছে। যেহেতু এই কম্পানিগুলো ইনকামই দেখাচ্ছে না, তাই ট্যাক্সও দিচ্ছে না। অথচ আয় না হলে তাদের অনেক কম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
প্রকৃতপক্ষে এসব দুর্বল কম্পানিকে শেয়ার ছাড়ার অনুমতি দেওয়াই উচিত হয়নি। গত ১০ বছরে যেসব কম্পানি বাজারে এসেছে, সেগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশই জাংক স্টক। তারা আইপিও ছেড়ে অর্থ নেওয়ার পরে চার বছরের মধ্যে ঋণখেলাপিও হয়েছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকের টাকা মারা। কারণ লিস্টেড কম্পানি হলে ব্যাংক একটু বেশি পরিমাণে অর্থ দেয়। সেটার সুযোগ নিয়েছে তারা। এই সুযোগে তারা ঋণখেলাপি হয়েছে। একদিকে ডিভিডেন্ট নেই, আরেক দিকে মানুষের টাকা-পয়সা দিচ্ছে না। এ রকম বহু কম্পানি আছে।
শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা হলো, ‘কোয়ালিটি অব স্টক’ বিবেচনায় ১০ বছর আগে যা ছিল তার থেকে খারাপ অবস্থায় চলছে। এর মধ্যে বেশ কিছু কম্পানি ওটিসিতে (ওভার দ্য কাউন্টার) চলে গেছে। অথচ ওটিসির ব্যাপারটা সমাধান করা উচিত ছিল। কারণ এর ফলে দায়মুক্ত হয়ে গেছেন উদ্যোক্তারা। তাই ওটিসিতে পাঠানো সমাধান নয়, সমাধান হচ্ছে করপোরেট গভর্ন্যান্স নিশ্চিত করা।
১০ বছর আগে, এমনকি সাত বছর আগেও অনেক কম্পানির অবস্থা ভালো ছিল, কিন্তু এখন খারাপ হয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেক বহুজাতিক কম্পানিও রয়েছে। যেমন বাটা। বাংলাদেশে বাটা ব্যবসা করছে পাকিস্তান আমল থেকে। সম্ভবত ১৯৯০ বা ১৯৮৯ সালে তারা আইপিওতে আসে। এর পর থেকে তারা অনবরত লাভ করেছে এবং ভালো ডিভিডেন্ট দিয়েছে। ২০ বছর ধরে তাদের অবস্থা কাহিল। এবার তারা ফাইনাল ডিভিডেন্টও দেয়নি। খবরে বলা হচ্ছে, বড় লোকসানে পড়েছে বাটা। আমি শুধু উদাহরণ হিসেবে বলছি যে একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির এই অবস্থা হয়েছে।
হাইডেলবার্গ সিমেন্টের কথা বলা যায়। একসময় যথেষ্ট ভালো কম্পানি ছিল। যেকোনো কারণেই হোক, তাদের অবস্থাও এখন ভালো নয়। তাদের শেয়ারের দাম সম্ভবত এখন ১৩৫ টাকার মতো। অথচ আমরা একসময় এই শেয়ার ৫০০ থেকে ৮০০, এমনকি এক হাজার টাকা দিয়েও কিনেছি। তারা ভালো ডিভিডেন্টও দিত। আরএকে সিরামিক প্রথম ১০ বছর অত্যন্ত ভালো ডিভিডেন্ট দিয়েছে। এখন কেউ এর খবর রাখে না। একসময় মুন্নু সিরামিকের শেয়ার হোল্ড করা ছিল বিশেষ কিছু। এটারও খোঁজখবর কেউ রাখে না। ফরাসি কম্পানি লাফার্জ সুরমা এখানে ১৩-১৪ বছর আগে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তেমন কিছুই পাননি। এর মধ্যে গত বছর তারা হোলসিমকে একীভূত করছে। এর পরও তাদের অবস্থা তেমন উন্নতি হয়নি। এর শেয়ারের দাম এখন ৩৯ টাকা। একসময় এর দামও ছিল ৪০০-৫০০ টাকা। অথচ এসব কম্পানির সব কয়টিই ‘ব্লু চিপ’ কম্পানি ছিল।
এই পরিস্থিতির কারণ হলো সরকার ও রাজস্ব বোর্ডের নীতিতে ত্রুটি রয়েছে। দেখা গেছে, যারা একটু ভালো করে তাদের ওপর বেশি কর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যাতে সরকার আয়কর বেশি পায়। এই নীতির কারণে যেসব কম্পানি উঁচু দরের ডিভিডেন্ট দেওয়ার কথা, তারাও সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের কথা বলা যেতে পারে। ২০০৯ সালে গ্রামীণফোন যখন শেয়ারবাজারে এলো, তখন তাদের ‘ডিফার্ড ইনকাম ট্যাক্স’ ছিল ১০ শতাংশ। মানে, একটি লিস্টেড কম্পানি হিসেবে নন-লিস্টেড কম্পানির থেকে তাকে করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স দিতে হতো ১০ শতাংশ কম। কিন্তু এর তিন বছর পরই ডিফার্ড ইনকাম ট্যাক্স ৫ শতাংশ কমানো হলো। এতে গ্রামীণফোনের হাজার হাজার শেয়ারহোল্ডার ঠকলেন। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো সরকারের রাজস্ব নীতির অস্থিরতা।
এখন কেউ যদি অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে আমার পরামর্শ চান, আমি বলব সংখ্যার দিক থেকে উপযুক্ত বিনিয়োগযোগ্য কম্পানির সংখ্যা খুব বেশি নেই মার্কেটে। এখন নতুন যে কমিশন এসেছে তারা অনেক ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা অনেক উদ্যোগ নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভালো কম্পানি লিস্টিংয়ে আনা।
ভালো কম্পানি আনার প্রসঙ্গে এলে আমি প্রথমেই প্রশ্ন করব বীমা কম্পানি মেটলাইফ-আলিকো কেন আসবে না? তাদের অধীনে দেশের পুরো বীমা ব্যবসার ৫০ শতাংশ। সেই কম্পানিকে যদি আমরা না আনতে পারি, তাহলে যাদের ব্যবসায় নেই, তাদের কয়েক ডজনকে লিস্টিংয়ে এনে তো লাভ নেই শেয়ারবাজারের জন্য। বলা হচ্ছে, মেটলাইফ তো ব্রাঞ্চ কম্পানি, লোকাল সাবসিডিয়ারি না। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলব, এদের লোকাল সাবসিডিয়ারি হতে বলেন না কেন? আর তারা ব্রাঞ্চ কম্পানি হয় কিভাবে? তারা বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্রাঞ্চ খুলে বসে রয়েছে। আমাদের দেশের কম্পানি ও তাদের মধ্যে পার্থক্যটা কী? তারা ব্রাঞ্চ কম্পানিগুলো করে ট্যাক্স দিচ্ছে কম। আবার শেয়ারবাজার লিস্টিংয়ে না যাওয়ার পথও একটা খুঁজে বের করেছে।
এর বাইরে সরকার চাইলে লিস্টিংয়ে আনতে পারে ইউনিলিভার ও নেসলেকে। স্থানীয় ওষুধ কম্পানিগুলোর মধ্যে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল শীর্ষ ১০টির মধ্যে আছে। অথচ শেয়ারবাজারে নেই। ইনসেপটা তিন নম্বরে আছে, টার্নওভারও বেশি। হেলথকেয়ার, সানোফি, অ্যারিস্টো ফার্মাও শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এরা শেয়ারবাজারে নেই। অথচ মুম্বাই, ব্যাংককসহ বিভিন্ন দেশের স্টক এক্সচেঞ্জে তারা ঠিকই আছে। নতুন শেয়ার হিসেবে মোবাইল ফোন কম্পানি রবিও বাজারে আসছে। তারা খুব মুনাফা না করলেও এ খাতে একটা লিডিং কম্পানি, দ্বিতীয় বৃহত্তম। তারা ভালো ডিভিডেন্ট দেবে এটা আশা করা যায়। তবে এমন কম্পানি থাকলে শেয়ারবাজারের ভাবমূর্তিও বাড়ে।
একটা বিষয় পরিষ্কার। এই সব কম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসা বিএসইসির একার পক্ষে সম্ভব নয়। কমিশনের কথা কম্পানিগুলো শুনতে চায় না। আইন ও নীতিগত কিছু সমস্যাও আছে। তাই শেয়ারবাজারে আনার জন্য এই কম্পানিগুলোকে হয় পুরস্কার দিতে হবে, না হয় শাস্তি দিতে হবে। সরকারের অর্থ বিভাগ, বোর্ড অব রেভিনিউ, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্য নীতিনির্ধারক সরকারি সংস্থাগুলোকে যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ভালো শেয়ারগুলোকে মার্কেটে তালিকাভুক্ত করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানের একটা সমন্বিত উদ্যোগ চাই। এর বাইরে সরকারি শেয়ারগুলো বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে নিতে পারে সরকার। ওসমানিয়া গ্লাস শিট, ইস্টার্ন কেবলসসহ কিছু কম্পানি আসতে পারে এই তালিকায়। এগুলো থেকে ১০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করলে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাবে সরকার। অথচ সরকার অর্থ সংস্থানের জন্য তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হাত দিচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : আফছার আহমেদ
মন্তব্য