<p>করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের সঙ্গে কাজ করছে বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী, বিশেষজ্ঞ, কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি; যার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় কমিটি। এর পরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারকে পরামর্শ দিতে গঠন করা জাতীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটি। পর্যায়ক্রমে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত এমন কমিটির কাঠামো রয়েছে প্রায় অর্ধশত। এর পরও সংক্রমণ প্রতিরোধে এদের অনেক পরামর্শ শেষমেশ মানা হয়নি, গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শুরুর দিকে তাদের পরামর্শে নেওয়া যেসব পদক্ষেপ তুলনামূলক কার্যকর ছিল, তা-ও এখন দ্রুত অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিদের্শনা না মানার প্রবণতা বাড়ছে।</p> <p>এই সময়ে জীবন-জীবিকার স্বার্থে সীমিত পরিসরে কিছু সেক্টর চালুর কথা থাকলেও কার্যত এখন আর সীমিত পর্যায়ে নেই। বরং সব কিছুই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে খোদ জাতীয় পর্যায়ের কমিটিগুলোর সদস্যদের মতেই।</p> <p>এসব নিয়ে আক্ষেপ ও অসন্তোষ বাড়ছে কোনো কোনো কমিটিতে। এমনকি কেউ কেউ এখন কমিটিতে তাঁদের থাকা না থাকার যৌক্তিকতা কিংবা তাঁদের পরামর্শ বা সুপারিশ দেওয়া না দেওয়ার পার্থক্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তবে কেউ কেউ এটাও বলছেন, তাঁদের সুপারিশ ও পরামর্শ অনুসারে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।</p> <p>নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কারিগরি কমিটির অন্তত তিনজন গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র সদস্য কালের কণ্ঠ’র কাছে আক্ষেপ করে বলেছেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে স্বাস্থ্য খাতের পক্ষ থেকে তাঁরা সংক্রমণ প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করছেন, স্বাস্থ্য খাতের বাইরের বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক পর্যায় থেকে তা পাত্তা পাচ্ছে না বরং সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারেরই দায়িত্বশীল কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা প্রকাশ হয়ে পড়ছে।</p> <p>ঠিক ওই কথার সঙ্গেই মিল পাওয়া যায় জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর কথার। তিনি অকপটে নিজেদের কিছু হতাশার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে ভীষণভাবে হতাশ হয়েছি এবং হচ্ছি। যেমন—আমাদের পরামর্শ কিংবা সংক্রামক ব্যাধির আওতায় বারবারই বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে; কিন্তু সামাজিক পর্যায়ে তা কার্যকর হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত মাস্ক না পরায় কারো বিরুদ্ধে কোনো জরিমানা বা শাস্তির নজির দেখলাম না। অথচ পথেঘাটে অগণিত মানুষকে দেখা যায় মাস্ক ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার দোকানপাট খোলা রাখার যে সময় দেওয়া হয়েছিল সেই সময় না মেনে অনেক রাত পর্যন্ত তা খোলা রাখা, জমজমাট বেচাকেনা, পাড়ায় পাড়ায় মানুষের আড্ডা, পথখাবারের দোকানে ভিড়, অপ্রয়োজনে যানবাহন নিয়ে সড়কে চলাচল—সবই আগের মতো হয়ে গেছে। অথচ পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুসারে এসব বিষয় দেখভালের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার দায়িত্বশীল ভূমিকা আমরা আশা করছিলাম।’</p> <p>ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কারিগরি কমিটির সদস্যরা কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নিজেরা গিয়ে তো আর দোকানপাট বন্ধ করতে পারেন না কিংবা পথে পথে মাস্ক পরার জন্য জরিমানা বা শাস্তি দিতে পারেন না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকেই দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। নয়তো আমরা শুধু পরামর্শ দিয়ে যাব; কিন্তু বাস্তবায়নে কাজের কাজ কিছুই হবে না। উল্টো সংক্রমণের মাত্রা আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু কেন যে মাস্ক ছাড়া ঘোরাফেরায় কাউকে ন্যূনতম শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, তা দেখে রীতিমতো বিস্ময় লাগছে। অথচ কেরালার মতো জায়গায় শুধু মাস্ক বাধ্যতামূলক করে, মানুষকে শাস্তির আওতায় এনে তারা সুফল পেয়েছে। অনেক দেশেই মাস্ক না ব্যবহার করায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্যরা সংশোধন হতে পারে।’</p> <p>অধ্যাপক শহিদুল্লাহ বলেন, ‘রোজার ঈদের আগে আমরা জনচলাচল ও শপিং মল বন্ধ রাখার জন্য বলেছিলাম; কিন্তু সেটি হয়নি। এবারও আমরা সেই পরামর্শ দিয়েছি; কিন্তু তা বাস্তবায়নের লক্ষণ এখনো দেখছি না। আশা করি এবার ঈদের সময় জনচলাচল বন্ধ থাকবে। নয়তো সামনে আরো খারাপ পরিণতি দেখতে হবে।’</p> <p>তবে জাতীয় করিগরি কমিটির চেয়ারম্যান তাঁদের পরামর্শের ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার উদাহারণ তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের কমিটি গঠিত হয় ১৮ এপ্রিল। ২০ এপ্রিল প্রথম সভা করে আমরা ২২ দফা সুপারিশ দিয়েছিলাম। প্রথম দিকে এর মধ্যে অনেকগুলোই ভালোভাবে কার্যকর হচ্ছিল। তবে সামাজিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে যেমন অনেক বিষয় হালকা হয়ে যায় বা উপেক্ষিত হয়, তেমনি আবার স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু কার্যকর ফল পাওয়া যায়। যেমন—আমরা কমিটি দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই বলেছিলাম, কভিড পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি বাড়াতে হবে, প্রতিদিন পরীক্ষার সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজারে নিয়ে যেতে হবে (তখন ছিল এক-দুই হাজার, এখন আমরা যেটা বলছি দিনে কমপক্ষে ২৫-৩০ হাজারের কথা)। আমাদের সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ কথা মানতে চাননি, এত পরীক্ষা লাগবে না বলেও অনেকে আমাদের বিদ্রুপ করেছেন; কিন্তু আমরা আমাদের পরামর্শে অটল থাকায় একে একে এখন ৭৫টি ল্যাবে পরীক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং পরীক্ষার সংখ্যা এখনো পর্যাপ্ত না হলেও ১৭-১৮ হাজারে উঠতে পেরেছে। আমরা পরীক্ষার জন্য আরটিপিসিআরের পাশাপাশি অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেনের সুবিধা চালুর কথাও বলেছি। ফলে সরকার এখন সেই পথেও এগোচ্ছে। সেই সঙ্গে তখন পর্যন্ত কভিড রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে যে চরম বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা ছিল, সেগুলো দেখতে আমরা ছয়টি দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে যেসব অব্যবস্থা-ঘাটতি দেখেছিলাম, তা জরুরিভাবে সমাধানের সুপারিশ করেছিলাম। সে অনুসারে কিন্তু চিকিৎসক, নার্সের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে, অন্যান্য জনবল নিয়োগ হচ্ছে, ডেডিকেটেড হাসপাতালের সংখ্যা বেড়েছে, হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সুবিধা, আইসিইউ, হাইফ্লো অক্সিজেন, লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের ব্যবস্থা হয়েছে। রোগীদের ভোগান্তি আগের তুলনায় অনেকাংশেই কমে গেছে। হাসপাতালগুলোতে সেবার মান বেড়েছে।’</p>