<p>ইংল্যাণ্ডের জনস্বাস্থ্য দপ্তর পিএইচই-এর এক জরিপে কভিড-১৯ সংক্রমণে ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।</p> <p>জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষত বয়স্ক মানুষ ও পুরুষদের করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এর পর বলা হচ্ছে বয়স ও লিঙ্গ বাদ দিলে করোনায় মৃত্যুর  সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি হচ্ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের। বলা হয়, কভিড-১৯ আক্রান্তদের কেসগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বয়স, লিঙ্গ, আর্থ-সামাজিকভাবে বঞ্চিত অঞ্চল-  এগুলোর প্রভাব বাদ দিলে দেখা যায়, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের কোভিডে মৃত্যুর ঝুঁকি শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের দ্বিগুণ।</p> <p>প্রতিবেদনটি বলছে, ব্রিটেনের কৃষ্ণাঙ্গ, চীনা, ভারতীয়, পাকিস্তানি ও অন্যান্য এশীয়দের মতো জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লোকদের করোনায় মৃত্যুর ঝুঁকি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। জরিপটির মূল বক্তব্যে আরো বলা হয়, কিছু পেশা যেমন নিরাপত্তারক্ষী, ট্যাক্সি বা বাসচালক, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী-  এদের করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।</p> <p>বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে টাইপ টু ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ) শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বেশি দেখা যায়। তাঁদের মতে, এই দুটি স্বাস্থ্য সমস্যাই তাঁদের কভিড সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।</p> <p>দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়দের মধ্যে যারা করোনায় মারা গেছেন তাঁদের মধ্যে আগে থেকে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বেশি ছিল।</p> <p>কেম্ব্রিজের অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেহে ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতার সঙ্গে কভিড-১৯এ মৃত্যু ঝুঁকির সম্পর্ক পাওয়া গেছে ২০টি ইউরোপীয় দেশে।</p> <p>যুক্তরাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়দের মধ্যে ভিটামিন 'ডি'-এর স্বল্পতা খুবই সাধারণ ঘটনা। যেসব দেশে রোদ কম পাওয়া যায় সেসব দেশেও তাই। ওএনএসের জরিপেও একই রকম কথা বলা হয়েছিল।</p> <p>কিছুদিন আগেই ব্রিটেনে ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর ওএন এস এক জরিপে প্রায় একই ধরনের ফলের কথা বলেছিল। তাতে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি- শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় ১ দশমিক ৯ গুণ। তার পরই আছেন বাংলাদেশিরা- তাঁদের মৃত্যু ঝুঁকি শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় ১ দশমিক ৮ গুণ।</p> <p>ওই জরিপেও বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বসবাসের পরিবেশ এবং পেশা- এ সবকিছুই এই উচ্চ মৃত্যুহারের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। এর কারণ জটিল।</p> <p>ম্যানচেস্টারে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশি  বংশোদ্ভূত এনাম হক। তিনি বলেন, 'কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়দের মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বেশি দেখা যায় এজন্য তাদের কভিড সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।'</p> <p>তবে ডা. হক আরো বলেন, এসব উপাত্ত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্যের পেছনে যে সামাজিক কারণগুলো থাকে সেগুলো আমার মতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।' তাঁর মতে, কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয়রা ব্রিটেনে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে থাকে সেটাই তাদের গুরুতর কভিড সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।</p> <p>ডা. এনাম হকের চাচা ডা.মঈন উদ্দিন বাংলাদেশের সিলেটে করোনা সংক্রমণে মারা গেছেন।</p> <p>লন্ডনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেকজন চিকিৎসক ডা. আবদুল্লাহ জাকারিয়া বলেন, এর কারণ কি নৃতাত্ত্বিক বা জিনগত কোনো বৈশিষ্ট্য নাকি আর্থ-সামাজিক-সাংসকৃতিক তা বলা কঠিন- এসব জরিপ থেকে তা এখনো পরিষ্কার হয়নি।</p> <p>তবে জাকারিয়া বলেন, 'এটি স্পষ্ট ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা বড় অংশ যে ধরনের কম মজুরির কাজ করেন তাতে তাঁদের বাস-ট্রেনের মতো গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হয়, অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়। ফলে তাঁদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সমাজের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অংশের চেয়ে বেশি।</p> <p>ডা. জাকারিয়া আরো বলেন, আরেকটি কারণ হলো বাংলাদেশিরা অনেকেই বড় পরিবার বা যৌথ পরিবারের সঙ্গে  থাকেন। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি এক্ষেত্রেও বেশি। অনেকে দারিদ্র্যের কারণেও উপযুক্ত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে পারেন না- এটিও একটা কারণ।</p> <p><strong>জিনগত না সামাজিক? </strong><br /> কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান উবেলে'র সমাজকর্মী মাইকেল হ্যামিলটন বলেন, জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিক হারে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর কারণ বায়োলজিক্যাল নাকি সমাজতাত্ত্বিক তা বলা অসম্ভব।</p> <p>মাইকেল বলেন, পিএইচই বলছে এটি একটি জটিল ব্যাপার। কিন্তু আসলে কারণ দুটোই। সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে আমাদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। অন্যদিকে শারীরবৃত্তীয় কারণে আমাদের এতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।</p> <p>ডা. এনাম হক জানান, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা করোনা আতঙ্কে ভুগছেন। তিনি বলেন, আমি নিজে বাংলাদেশি পরিবার থেকে আসা। তাই একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করাটা আমার জন্যও আতঙ্কজনক। কারণ আমার জাতিগত সংখ্যালঘু অনেক সহকর্মীকে আমি মারা যেতে দেখেছি।</p> <p><strong>অনেক বেশি লোক এক বাড়িতে </strong><br /> ব্রিটেনে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চালানো এক জরিপের পর ইংলিশ হাউজিং সার্ভে বলছে, এক বাড়িতে গাদাগাদি করে অধিক সংখ্যক লোক থাকার হার বাংলাদেশি পরিবারগুলোতে সবচেয়ে বেশি।</p> <p>জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশিদের ৩০ শতাংশ বাড়িতেই অতিরিক্ত সংখ্যক লোক থাকেন। পাকিস্তানি বাড়িগুলোতে এ হার ১৬ শতাংশ, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ১২ শতাংশ। অন্যদিকে ব্রিটেনের শ্বেতাঙ্গদের বাড়িতে অতিরিক্ত লোক গাদাগাদি করে বাস করছে- এমন হার মাত্র ২ শতাংশ।</p> <p>সরকারি প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ব্রিটেনের বঞ্চনার শিকার এলাকাগুলোতে যারা বাস করেন তাদের করোনা আক্রান্ত হওয়া এবং তাতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম বঞ্চিত এলাকাগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। এইসব বঞ্চিত এলাকাকাগুলোর ১০ শতাংশতেই আবার কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় এবং মিশ্র-জাতিসত্ত্বার লোকদের বাস করার সম্ভাবনা বেশি।</p> <p><strong>কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়দের কাজের ক্ষেত্রও ঝুঁকির কারণ </strong><br /> জরিপে বলা হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে বহু কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়ই যে ধরনের কাজ করেন তা-ও করোনা আক্রান্ত হওয়ার অতিরিক্ত ঝুঁকির একটি বড় কারণ। তারা সুপারমার্কেটের চাকরি, ট্যাক্সি চালানো, ডেলিভারি ড্রাইভার, - এ ধরনের কাজ শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বেশি করেন।</p> <p>ইংল্যান্ডে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা এনএইচএসের ২১ শতাংশ কর্মীই জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু পরিবার থেকে আসা, কিন্তু মোট জনসংখ্যার তারা মাত্র ১৪ শতাংশ। করোনা মহামারির সময় এসব কাজ জরুরি সেবার পর্যায়ে পড়ে। ফলে এসব ক্ষেত্রে কর্মীদের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা অপেক্ষাকৃত কঠিন।</p> <p>লন্ডনের একজন উবার ড্রাইভার ছিলেন রাজেশ জয়াসিলান। তিনি করোনা সংক্রমণে মারা যান এপ্রিলে। মৃত্যুর মাত্র কয়েক‌দিন আগে তাঁর বাড়িওয়ালা তাঁর কাজের কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে তাঁকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন। তিনি বাধ্য হন রাতে তাঁর গাড়িতে ঘুমাতে।</p> <p>গত মাসে বার্মিংহ্যামের এনএইচএস কর্মকর্তা ক্যারল কুপার বলেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয় নার্সদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা মনে করছেন তাঁদেরকে শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীদের তুলনায় বেশি হারে হাসপাতালের কভিড ওয়ার্ডে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে।</p>