<p>ধানের কম দাম নিয়ে হাহাকারের সঙ্গে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। কৃষকদের অসহায় মুখ দেখে ধানের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে তাদের সন্তানরা। এতে যোগ দিয়েছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিতরাও। ‘আমরা ছাত্র, কৃষকের সন্তান। কৃষকের খরচের চেয়ে ধানের দাম কম কেন’—এ স্লোগান তুলেছেন তাঁরা। প্রতিবাদও উঠছে জোরেশোরে। এমন বক্তব্য এসেছে যে ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে’—এই বক্তব্য আজ মিথ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধানের দাম ১০ টাকা কেজি অথচ চাল ৬০ টাকা কেজি। তাহলে কৃষকের এই উৎপাদিত পণ্যের লাভ কারা নিচ্ছে?  কৃষককে বাঁচাতে হবে, তাহলেই বাঁচবে দেশ।</p> <p>দাম না পেয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে টাঙ্গাইলে ক্ষেতের ধানে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি খাদ্যমন্ত্রী অবিশ্বাসের চোখে দেখায় তাঁর কঠোর সমালোচনাও হচ্ছে। জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন খাদ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনি কৃষকের সঙ্গে মশকরা করতে পারেন না। আপনি, আমি কৃষকের ভোটে, কৃষকের দয়ায় সংসদে এসেছি।’</p> <p>দাম কম হওয়ায় গতকাল জয়পুরহাটে ধানে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ করেছে ক্ষেতমজুর সমিতি। সারা দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ দেশের ১৬টি স্থানে ধানের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যেও মানববন্ধন করেছে তারা। প্রতিবাদ হয়েছে ভোলা, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহে। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদে রাস্তায় নামে।</p> <p>এবার দেশে আমনের পর বোরো মৌসুমেও বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশির আভা ফুটেছিল কৃষকের মুখে। তবে সেই খুশি মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। স্থানভেদে ৪০০-৫০০ টাকায় ঘুরছে প্রতি মণ ধানের দাম। অথচ প্রতি মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে ৭০০-৮০০ টাকা। গড়ে মণপ্রতি ৩০০ টাকা লোকসান হচ্ছে কৃষকের। জনবল সংকটে কোথাও কোথাও ফসল কাটার খরচই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকের জন্য। দুই মণ ধানের দামেও একজন দিনমজুর মিলছে না কোথাও কোথাও। এ নিয়ে কালের কণ্ঠে গতকাল প্রধান শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।</p> <p>ধানের দাম কম হওয়ার পেছনে বিভিন্ন জায়গায় মজুদদার ও মিল মালিকদের কারসাজি দেখছেন কৃষক ও বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি দ্রুত সংস্কার করার দাবিও জানাচ্ছেন তাঁরা। বিশেষ করে চাল সংগ্রহের নামে মিলার-ডিলারদের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের সুযোগ করে দেওয়ার পদ্ধতি বাদ দিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কেনার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বোরো মৌসুমে এখনো সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ হয়নি মোটেই। মাঠপর্যায়ে খাদ্য কর্মকর্তারাও ধান সংগ্রহে অনেকটা নির্লিপ্ত বলে অভিযোগ আছে।</p> <p><strong>বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, ধানে প্রতীকী আগুন</strong></p> <p>গতকাল দুপুরে জেলা ক্ষেতমজুর সমিতির ব্যানারে জয়পুরহাট শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদ চত্বরে ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা সড়কে ধান ছিটিয়ে ও ধানে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানায়।</p> <p>জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার মিনিগাড়ী গ্রামের কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমান দামে ধান বিক্রি করে তাঁর বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। ‘এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা মারা পড়ব’—বলেন তিনি। সদর উপজেলার বামনপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র চাষি। ধানের যে দাম তাতে পরিবার নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়েছে। বাধ্য হয়ে কৃষকের কষ্টের কথা সরকারকে জানানোর জন্য রাজপথে নেমেছি।’ ক্ষেতলালের কোড়লগাড়ি গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলী, মহসীন আলী বাবু, দুল, কানপাড়ার সুজাউল ইসলাম জানান, একে তো ধানের দাম নেই, তার ওপর শ্রমিক সংকট নিয়ে তাঁরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। এক বিঘা জমির ধান কাটতে পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে।</p> <p>ধান বেচতে না পারার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এম এ রশিদ। বলেন, ‘ব্রি ২৮ জাতের সাড়ে তিন বিঘা জমির ধান ভ্যানযোগে বিক্রি করতে পাঠিয়েও তিনি বিক্রি করতে পারেননি। সারা দিন ঘুরে ব্যর্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ধানের কেউ দাম পর্যন্ত বলেনি। এতে তাঁর ৩০০ টাকা ভ্যানভাড়া লোকসান দিতে হয়েছে।’</p> <p><strong>কৃষকের পাশে তাদের শিক্ষিত সন্তানরা</strong></p> <p>গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক মানববন্ধনে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, সরকার কৃষকদের পরিবর্তে বড় বড় চোরদের রক্ষায় ব্যস্ত রয়েছে।’  ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ ব্যানারে আয়োজিত এ মানববন্ধনে ধানসহ সব কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ, কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদান ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনার দাবি জানানো হয়। সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসান আল মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষক রক্ত-ঘামে ধান উৎপাদন করে আর মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হয়। কিন্তু সরকার কৃষককে না বাঁচিয়ে মুনাফালোভীদের রক্ষা করতেই ব্যস্ত। আমরা কৃষকের সন্তান, কৃষককে ঠকিয়ে উন্নতি করা সম্ভব হবে না।’</p> <p>নুরুল হক নুর বলেন, ‘যাদের উৎপাদিত পণ্য খেয়ে বেঁচে আছি তাদের সঠিক মূল্য আমরা দিতে পারছি না। মন্ত্রীরা বক্তব্য দিচ্ছেন ধান বেশি হওয়ায় দাম কমে যাচ্ছে। অথচ চালের দাম ঠিকই বেশি। এটি কারণ নয়, সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমে যাচ্ছে। চালকল মালিকরা পরিকল্পিতভাবে দাম কমিয়ে দিয়েছেন। কৃষকরা ন্যায্য মূল্য না পেলে ছাত্রসমাজ দাবি আদায়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে। কৃষক ও ছাত্র একসঙ্গে মাঠে নামলে সরকার ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।’</p> <p>ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ‘আমি ছাত্র, আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। এক মণ ধানের দাম ৪৫০-৫০০ টাকা। এই ধান থেকে চাল হয় এক হাজার ২০০ টাকার। ৭০০ টাকা তারা খেয়ে ফেলছে। সিন্ডিকেট এই টাকা মেরে দিচ্ছে। অথচ বীজ উৎপাদন থেকে শুরু করে ধান উৎপাদন পর্যন্ত কৃষকদের কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয় তা আমরা জানি। এর ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার দায় রাষ্ট্রের।’</p> <p>জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে—এই বক্তব্য আজ মিথ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের উৎপাদিত ধানের দাম ১০ টাকা কেজি অথচ আমরা চাল কিনি ৬০ টাকা কেজি। তাহলে এই কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের লাভ কারা করছে? সরকারকে সেটা বের করতে হবে।’</p> <p>‘আর করব না ধান চাষ, দেখব তোরা কী খাস। কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ, গড়ব সোনার বাংলাদেশ’—এই স্লোগান তুলে ভোলার চরফ্যাশনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ধানসহ সব কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণসহ পাঁচ দফা দাবিতে মানববন্ধন করেছে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নারায়ণগঞ্জ জেলার আহ্বায়কর আবু তালহা আব্দুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ আগেও কৃষিনির্ভর ছিল, এখনো কৃষিনির্ভর রয়েছে। যদি দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে চাও তাহলে কৃষিকে বাঁচাতে হবে।</p> <p><strong>সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টে পরিকল্পিতভাবে ধানে আগুন :  খাদ্যমন্ত্রী</strong></p> <p>নিজের সন্তান বিকলাঙ্গ হলেও কোনো মা-বাবা কখনো গলা টিপে তাকে হত্যা করবে না। ঠিক তেমনি কোনো কৃষক আগুনে পুড়িয়ে তার ধান নষ্ট করবে না। গতকাল সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা খাদ্যগুদামে প্রান্তিক কৃষক ও মিলারদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধান ও চাল ক্রয় উদ্বোধন শেষে খাদ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন। কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না—এটা স্বীকার করলেও মন্ত্রী বলেন, ধানের দাম ২০০ টাকা মণ হলেও একজন কৃষক কখনো ধান পোড়ানোর মতো কাজ করবে না। এটি একটি মহলের পরিকল্পিত ঘটনা, যাতে সরকারকে বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলা যায়।</p> <p>তিনি একই সঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশের উৎপাদিত চাল বিদেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করছে সরকার। আমরা সরকারিভাবে প্রান্তিক কৃষক ও মিলারদের কাছ থেকে ধান-চাল ক্রয়ের যে বরাদ্দ দিয়েছি তাতে যেন জোরেশোরে ক্রয় শুরু করা হয়, যেন বাজারে প্রভাব পড়ে। স্থায়ী সমাধানের জন্য যেসব এলাকায় বোরো ধান বেশি উৎপাদিত হয়, সেখানে প্যাডিক সাইক্লোডাই এবং ফ্যানি মেশিন দিয়ে আমরা যাতে ১০ লাখ মেট্রিক টন ধান কিনতে পারি সে ব্যবস্থা করা হবে।’</p> <p><strong>খাদ্যমন্ত্রীকে হুইপ :  কৃষকের সঙ্গে মশকরা  করতে পারেন না</strong></p> <p>খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পরই ফেসবুক পোস্টে জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন তাঁর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনি কৃষকের সঙ্গে মশকরা করতে পারেন না।’ তিনি লেখেন, ‘ক্ষমতা কি মানুষকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দেয়? আমার জানা মতে, সুস্থ চোখ অন্ধ হতে সময় লাগে। কিন্তু মাত্র চার মাসে ধানের ভাণ্ডার নওগাঁর গাঁও-গেরাম থেকে উঠে আসা খাদ্যমন্ত্রী গাঁয়ের কৃষকদের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ভুলে গেলেন! অন্ধ হয়ে গেলেন এসির ঠাণ্ডা বাতাসে! তিনি বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করার জন্য নাকি কৃষক ষড়যন্ত্র করে পাকা ধানে আগুন দেওয়ানো হয়েছে!’</p> <p>স্বপন লেখেন, ‘একজন অসহায় কৃষকের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকেও সহ্য করতে পারবেন না? আপনি তো সামরিক স্বৈরাচারের মন্ত্রী নন। আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে, আপনি পরম ধৈর্যশীল, পরমতসহিষ্ণু, উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বসেরা রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী এবং তাঁর সম্মানিত সহকর্মী।’ স্বপন আরো লেখেন, ‘আগুন দিয়েছে নিজের ক্ষেতে, আপনার পাঞ্জাবিতে দেয়নি। তাতেই সহ্য হচ্ছে না! শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারটুকুও দেবেন না কৃষককে। কৃষক বলে কি তাদের প্রতিবাদ করার অধিকার নেই! কৃষক উৎপাদন করে, ন্যায্য মূল্য পায় না। এ কথা অন্য রাজনীতিবিদ না জানলেও আপনার, আমার অজানা নয়। ধানের দামের খোঁজ নেন, দেখেন, হাটে-বাজারে ধানের প্রকৃত দাম কত? আপনি এই মন্ত্রণালয়ে নতুন। কথিত আছে, এই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ খাদ্য বিভাগের শুধু কর্মচারী নয়, অফিসের দেয়ালও নাকি ঘুষ চায়। ভূমিমন্ত্রীর মতো সচল হোন, দুর্নীতির জঞ্জাল পরিষ্কার করুন।’</p> <p>[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা]</p>