<p>বরিশাল অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় সম্মুখযুদ্ধ হয় ঝালকাঠির চাচৈর গ্রামে। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর দুপুরে শুরু হয়। নিহত হয় সাত পাকিস্তানি হানাদার সেনা। রাত ৮টার দিকে সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ নিয়ে পিছু হটে তারা। এরপর আরো কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে ওই অঞ্চলে। ৮ ডিসেম্বর থানা আক্রমণের মধ্য দিয়ে নলছিটিকে হানাদারমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে ঝালকাঠির নলছিটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেকেন্দার আলী মিয়া স্মৃতিচারণা করে কালের কণ্ঠকে এসব কথা বলেন।</p> <p>সেকেন্দার আলী বলছিলেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিলের নির্দেশে তিনি বরিশালের বেলস্ পার্কে গোপন বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হয়। ওই বৈঠকেই তাঁকে নলছিটি থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ১৯৬৪ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করেন তিনি। পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিল তাঁর কর্মস্থল। পরে তাঁকে যশোরে বদলি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে যুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যশোর থেকে পালিয়ে নলছিটি গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন সেকেন্দার আলী। তিনি জানান, চাচৈর গ্রামে সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও তিনি কাঁঠালিয়া, বাকেরগঞ্জ ও দরগাবাড়ীর সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।</p> <p>চাচৈর যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে সেকেন্দার আলী মিয়া বলেন, চাচৈর ক্যাম্পে প্রায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা বৈঠক বসেন। আলোচনা হচ্ছিল কিভাবে ওই অঞ্চল থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের হটানো যায়। এরই মধ্যে ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর খবর পাঠান যে চাচৈর ক্যাম্পে হামলা করার জন্য পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে আসছে। তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে চাচৈর ক্যাম্পে আসেন। আশপাশের এলকায় অবস্থান করা আরেক মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাস্টারও তাঁর দল নিয়ে আসেন। মান্নান আসেন আরেকটি দল নিয়ে।</p> <p>সেকেন্দার আলী বলেন, ‘চারপাশ থেকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা চাচৈর ক্যাম্পে এলো। চাঁন মিয়া নামের একটি ছেলেকে সামনে পাহারায় রাখি। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই গাড়ির শব্দ। আচমকা গাড়ির শব্দ শুনে সহযোদ্ধাদের মন আঁতকে ওঠে। চাঁন মিয়া ভুল করে একটি ফায়ার করল। উঁকি দিয়ে দেখি সাতটি গাড়িতে করে ১০০-এরও বেশি পাকিস্তানি সেনা এসেছে। সাহস হারাইনি। সবাইকে সাবধান হতে বলি। আমার কাছে একটি এলএমজি এবং অন্যদের কাছে ৭০-৮০টি থ্রিনটথ্রি রাইফেল ছিল। তা-ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দুপুর তখন ১টা। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনারা। আমরাও চারদিক থেকে গুলি চালাই। বিকেল তখন সাড়ে ৪টা। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আবদুল আউয়ালের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। লুটিয়ে পড়েন তিনি।’</p> <p>সেকেন্দার আলী বলেন, আউয়াল শহীদ হওয়ার পর জীবনবাজি রেখে সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে তারা। একপর্যায়ে সাতজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। লাশ পড়তে দেখে পিছু হটতে শুরু করে তারা। রাত তখন সাড়ে ৮টা। মৃতদেহগুলো নিয়ে নিমেষেই পিছু হটে হানাদাররা। তিনি বলেন, ‘৯ নম্বর সেক্টরের সবচেয়ে সফলতম যুদ্ধ ছিল চাচৈর যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সংবাদ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের রেডিও থেকেও প্রচার করা হয়।’</p> <p>সেকেন্দার আলী মিয়া বলেন, ‘ওই রাতেই আমার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নলছিটি থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমরা তখন সংখ্যায় ছিলাম দুই গ্রুপে ৪০ জন। থানার পশ্চিম ও পূর্ব পাশে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যাই। রাতের আঁধারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। থানার ভেতরে থাকা পুলিশের অবস্থান বোঝার জন্য একটি ফায়ার করি। পুলিশ আমার অবস্থান আঁচ করতে পেরে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটি গুলি এসে লাগে আলমের গায়ে। তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আমরা আর সামনের দিকে যাইনি। এরই মধ্যে আরেকটি গুলি এসে লাগে মালেকের গায়ে। তিনিও নিহত হন। এরপর আমরা আমাদের অবস্থান ত্যাগ করি। চলে যাই বাহাদুরপুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে।’</p> <p>সেকেন্দার বলছিলেন, ১৪ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী থানা আক্রমণের খবর পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা দেওপাশা ও পরমপাশা গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন। গ্রামবাসীর এ বিপদের মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন হানাদারদের সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ যুদ্ধ। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদ ও কবির হোসেন শীতলপাড়া পুলের নিচে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁরা দুজনই নিহত হন। তাঁদের রক্ষা করতে গিয়ে সুবেদার করিম আহত হন। আমরা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এ সময় আমাদের গুলিতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পিছু হটতে শুরু করে তারা। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে গ্রামবাসীও ওই যুদ্ধে অংশ নেয়।’</p> <p>১৭ নভেম্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ফয়রা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই শুরু হয়। সে যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে সেকেন্দার আলী বলেন, ‘আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী এসে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরাও তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করি। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় দরগাবাড়ী কাঞ্চন আলী খানের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। তারা সিদ্ধকাঠি যাওয়ার পথে আমাদের সঙ্গে আবার যুদ্ধ হয়। এ সময় কয়েকজন সেনা মারা যায়। পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।’</p> <p>এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলেন, ‘৭ ডিসেম্বর আমরা নলছিটি থানা আক্রমণের প্রস্তুতি নিলাম। যত বাধাই আসুক আজ থানা আক্রমণ করতে হবেই—এমন মনোবল নিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে থানা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালালাম। পুলিশ বাহিনী আমাদের অবস্থান দেখে ঘাবড়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর নলছিটি থানার এসআই সিদ্দিক হোসেন তার পুলিশ বাহিনী, রাজাকার আলবদরদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর এই দিন হানাদারমুক্ত হয় নলছিটি।’</p> <p>বীর মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার আলী মিয়া বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সেই সব স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভাসে। অনেক কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমার প্রত্যাশা, স্বাধীন দেশের প্রতিটি মানুষ যেন স্বাধীনতাকে রক্ষা করে।’</p>