<p>টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার মালিক ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর কবরস্থানে ‘সি’ ব্লকে ২৬টি কবর কেন কিনে রেখেছেন সে প্রশ্নের উত্তর একেকজনের কাছে একেক রকম। কেউ বলছেন, এটি হচ্ছে বিত্তের প্রভাব। কারো কারো মতে, এটি ব্যবসায়িক বিনিয়োগ। গতকাল শনিবার বিকেলে ওই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বনানী কবরস্থানকর্মী সুজন বলেন, ‘অগ্রিম সংরক্ষণের জন্য কিনে রাখা এসব কবরের প্রতিটির দাম এখন ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা।  প্রকাশ্যে তো আর এসব কবর বেচাকেনা হয় না। তবে আমাদের কাছে খবর পৌঁছে যায়।’</p> <p>গাজীপুরের টঙ্গীতে ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৩৪ জনের মৃত্যু, ৩৫ জন আহত হওয়া এবং ১০ জন নিখোঁজ থাকার মর্মান্তিক ঘটনা উল্লেখ করে সুজন বলেন, ‘আমার বাড়িও ওই কারখানা এলাকায়ই।’</p> <p>টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে টাম্পাকো কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলে যাননি মকবুল হোসেন। ওই সময় থেকে তাঁকে প্রকাশ্যে দেখাও যায়নি। ওই ঘটনায় তাঁর নামে এরই মধ্যে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।</p> <p>এদিকে বনানী কবরস্থানের সিনিয়র মোহরার আব্দুল হান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, আগের বরাদ্দ ছাড়া এখন এ কবরস্থানে সংরক্ষণের জন্য আর একটি কবরও অবশিষ্ট নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানেরও কবর হয়েছে তাঁর স্ত্রী আইভি রহমানের কবরে।</p> <p>১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে অগ্রিম সংরক্ষণের জন্য ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকায় ওই কবরগুলো কিনেছিলেন ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন। কেনার সময় বনানী কবরস্থানের কর্মীদের তিনি বলেছিলেন, তাঁর পাশেই তাঁর সন্তান ও সন্তানের সন্তানদের কবর না হলে পরবর্তী বংশধররা তাঁকে ভুলে যাবে। কবর জিয়ারতও ঠিকমতো হবে না। এ জন্যই আগে থেকে এতগুলো কবর সংরক্ষণ করে রাখা।</p> <p>ওই কবর কেনার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলে ২০০০ সালে ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘সুযোগ ছিল এবং আমার সামর্থ্যও রয়েছে বলে কবরগুলো কিনে রেখেছি। টার্গেট ছিল ৪৪টির। সে মর্মে আবেদনপত্র এবং টাকাও জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে সময় আমার বিদেশে অবস্থানের সুযোগে কর্তৃপক্ষ কিছু কবর অন্যদের দিয়ে দেয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে নাসিম বিশ্বাসের কবর হয় আমারই আবেদনকৃত জায়গায়। এসব জেনে-বুঝে আর দেরি করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত ২৬টি কবরই অগ্রিম সংরক্ষণের জন্য চূড়ান্তভাবে বরাদ্দ এবং দেয়াল দিয়ে ঘিরে নিয়েছি।’</p> <p>কবরস্থানের রেজিস্টারের তথ্য অনুসারে মকবুল হোসেন ১৯৯৬ সালের ৪ নভেম্বর, ১৯৯৭ সালের ৩ মে এবং ১৯৯৮ সালের ২৮ জুলাই তিনটি আবেদনের মাধ্যমে ওই কবরগুলো বরাদ্দ নেন। এসব আবেদনের মধ্যে একটিতে নিজের ঠিকানা ১২ নম্বর ইস্কাটন রোড এবং অন্য দুটিতে বাড়ি নম্বর ১৮/এ, রোড ১৫, ধানমণ্ডি উল্লেখ করেন। বর্তমানে ১২ নম্বর ইস্কাটন রোডে মকবুল হোসেন নামের কেউ থাকেন না।</p> <p>জানা যায়, ২০০০ সালের প্রথমদিকে ২৬টি কবর ঘিরে রেখে সেখানে ‘ড. মকবুল হোসেন-এর পারিবারিক কবরস্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ডও ছিল। কিন্তু ওই সময় বিষয়টি ব্যাপক সমালোচিত হলে সাইনবোর্ড থেকে ‘পারিবারিক কবরস্থান’ শব্দ দুটি মুছে দেওয়া হয়। এখন দুটি নামফলকে লেখা রয়েছে, ‘ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন/ প্রাক্তন এমপি/ সিলেট/ ১৯৯৮।’</p> <p>কবরস্থান কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, ১৯৯৩ সালে বানানী কবরস্থানে প্রতিটি কবরের মূল্য বাড়িয়ে চলতিভাবে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ৬০ হাজার টাকা ও অগ্রিম সংরক্ষণের জন্য এক লাখ ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। তখন ধারণা ছিল, দাম বেশি হওয়ার ফলে কবর সংরক্ষণের চাহিদা কমবে। কিন্তু তা কমেনি। এরপর ২০০০ সাল থেকে অগ্রিম সংরক্ষণের জন্য আর কোনো কবর বরাদ্দ হয়নি।</p> <p>ড. মকবুল হোসেন ছাড়াও বনানী কবরস্থানে সর্বোচ্চ ৪৫টি কবর অগ্রিম সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ রয়েছে অপসোনিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল খালেক খানের পরিবারের নামে। তবে কবরস্থানকর্মীদের ধারণা, যৌথ পরিবার হিসেবে এ পরিবারটির সদস্যসংখ্যাও অনেক। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে ওই পরিবারের পক্ষ থেকে আব্দুর রউফ খান, আব্দুর রাকিব খান ও আব্দুস সবুর খান সাতটি আবেদনের মাধ্যমে কবরগুলো বরাদ্দ নেন। এ ৪৫টি কবরের মধ্যে আটটিতে এরই মধ্যে দাফন সম্পন্ন হয়েছে ওই পরিবারের মৃত সদস্যদের। আর ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের কেনা কবরে দাফন হয়েছে দুজনের।</p> <p>ফয়েল পেপার উৎপাদনকারী টাম্পাকো কারখানার মালিক ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে দুইবার সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯১ সালের পর তিনি যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এক-এগারোর পর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি।</p>