<p>অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে।</p> <p>“ওরা কারা বুনো দল ঢোকে </p> <p>এরি মধ্যে (থামাও, থামাও); স্বর্ণশ্যাম বুক ছিঁড়ে</p> <p>অস্ত্র হাতে নামে সান্ত্রি কাপুরুষ, অধম রাষ্ট্রের</p> <p>রক্ত পতাকা তোলে কোটি মানুষের সমবায়ী </p> <p>সভ্যতার ভাষা এরা রদ করবে ভাবে...”</p> <p>অমিয় চক্রবর্তী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন। আগস্ট এলেই আমরা দেখি বাংলাদেশের বিপক্ষে জড়ো হয় বাংলাদেশবিরোধীরা। জামায়াত-শিবির; পাকিস্তানপন্থী হায়েনারা।</p> <p>তাদের প্রস্তুতি আগে থেকেই থাকে। আর তাইতো এবার ওরা আগস্ট পর্যন্তও অপেক্ষা করেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের পর সারা দেশে একসঙ্গে আবার তাদের তাণ্ডব দেখল বিশ্ববাসী। মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হানিফ ফ্লাইওভার, সেতু ভবন [পদ্মা সেতুর প্রতীক], বিটিভি, হাসপাতাল, ফায়ার স্টেশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, এমনকি জেলখানা কিছুই বাদ গেল না ওদের ছোবল থেকে।</p> <p>ভবন-গাড়ি পুড়ে কঙ্কাল হয়ে আছে। দেখে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। অথচ এমন হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। ছাত্ররাও চায় কোটা সংস্কার হোক, সরকারও চায় কোটা সংস্কার হোক—তাহলে কেন এই হত্যার উৎসব? সরকারি হিসেবে [২৯ জুলাই] মৃত্যুর সংখ্যা ১৫০-এ দাঁড়িয়েছে।<br /> এই সংখ্যাটা বাড়বে।</p> <p>এক একটি প্রাণের মূল্য কত তা যারা স্বজন হারিয়েছে তারাই জানে। যারা সন্তান হারিয়েছে তারাই জানে। যাত্রাবাড়ীতে এক পানির বোতল সাপ্লাইয়ার নিজের কাজ করার সময় গুলিতে মারা যায়। তার স্ত্রী শোক সইতে না পেরে [২৯ জুলাই] আত্মহত্যা করে।</p> <p>শুধু এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায় এই ক্ষতটা কত বড় ক্ষত। জাতির একটি অংশ এখন ট্রমায় ভুগছে। আমরা খুব ভালো করেই জানি, যারা চলে গিয়েছে তারা আর কোনো দিন এই পৃথিবীতে আসবে না। তারা আমার-আপনার মতো এই আলো-হাওয়া দেখবে না, অনুভব করবে না।</p> <p>জুলাইয়ে আগস্টের ষড়যন্ত্রশোকাবহ আগস্টের শুরু হলো। মনে এবার আরো বেশি সংশয় জাগে। ওরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার জন্য বেছে নিয়েছিল ১৫ আগস্ট [১৯৭৫]। যে দিনটি ভারতের স্বাধীনতা দিবস [১৫ আগস্ট ১৯৪৭]। ভারতের স্বাধীনতা দিবসটিকেই কেন ইতিহাসের এই নারকীয়-দানবীয় হত্যাকাণ্ডের দিন হিসেবে বেছে নিতে হবে? এটা অবশ্যই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের কাজ ছিল না। কারণ এটি ছিল রাজনৈতিক। সৌদি আরব বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সালে। কিন্তু কেন? বঙ্গবন্ধু সৌদি বাদশাহর কথা শোনেননি এ জন্য? সৌদি বাদশাহ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশের সরকারি নাম ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ বাদ দিয়ে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ রাখেন তবেই স্বীকৃতি।” বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রাখার কোনো কারণ খুঁজে পাননি। কারণ বাংলাদেশ আগে তো ইসলামী দেশেরই অংশ ছিল। শোষণমুক্তির প্রয়োজন থেকেই এই অসাম্প্রদায়িক দেশের জন্ম হয়। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকা অবস্থায় ওরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এটা অবশ্যই রাজনৈতিক। যে মানুষটা বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন। আমরা যাঁর জন্য একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। প্রকৃতপক্ষে মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলতে পারছি। পাখির মতো ওড়ার স্বাদ পাচ্ছি, সেই মানুষটিকেই মুক্তিযুদ্ধের পর ওরা টার্গেট করেছিল। প্রমাণিত হয়েছে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। উইকিলিকস কিছু তথ্য ফাঁস করেছিল, তা থেকেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।</p> <p>ওরা একুশে আগস্টকে [২০০৪] বেছে নিল বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করার মিশন হিসেবে। ভিশন ছিল আরো বড়। শুধু শেখ হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্যই হামলাকারীরা গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। সবাই যদি আরেকটু দূরদর্শী হন, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন এই হামলা যেনতেন হামলা নয়; একটি নির্দিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর দায় চাপালেই হয় না; এখানে রাষ্ট্র সরাসরি জড়িত ছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে এত বড় হামলা সম্ভব নয়। সরকারের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে এ হামলা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা তখন কারা ছিলেন? বিএনপি-জামায়াত তথা চারদলীয় জোট। জজ মিয়া নাটকের পর আদালতের রায়ে তা স্পষ্ট।</p> <p>সেদিন কি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে? বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এদিন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী সমাবেশ করছিল আওয়ামী লীগ। যে ট্রাকটিকে (ঢাকা মেট্রো-ট-১১-৩০৯৮) উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয়েছিল, সেটিকে ঘিরে সেদিন শনিবার দুপুর ২টা থেকেই দলীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ভিড় করছিলেন। পুরো এলাকা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে মুখরিত ছিল। বিকেল ৫টায় সমাবেশস্থলে আসেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। বিকেল ৫টা ২ মিনিটে মঞ্চে উঠে বক্তব্য শুরু করেন। টানা ২০ মিনিট বক্তব্য দিলেন। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে নিজেই জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু  স্লোগান দিয়ে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে মাইক নামাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই শুরু জঘন্যতম হামলার মুহূর্ত। বিকট শব্দে কেঁপে উঠল মঞ্চটি। এরপর একে একে আরো বেশ কয়েকটি জোরালো শব্দ, চারদিকে ধোঁয়া। এর মাঝ থেকে ছুটে আসছে শত শত মানুষের আর্তনাদ। রাস্তায় পড়ে আছেন আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী-সমর্থক। ট্রাকের ওপর মানবদেয়াল ঢেকে রেখেছে বাংলাদেশের স্থপতির মেয়েকে। মঞ্চের দক্ষিণ পাশ থেকে ছোড়া একটি গ্রেনেড একেবারে কাছে এসে পড়ে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডটি। মঞ্চ টার্গেট করে দক্ষিণ পাশ থেকে একের পর এক গ্রেনেড হামলা হতে থাকে। মাত্র দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয় সমাবেশস্থলে। মানবদেয়ালে ঢাকা শেখ হাসিনা। প্রতিটি সেকেন্ড হাজার বছরের সমান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে নেওয়া হয় তাঁর বুলেট প্রুফ গাড়িতে। সেখানেও গুলি। গাড়ি চলে সুধা সদনের দিকে। সেদিন শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও তাঁর কান ও চোখ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেদিন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানের পা গ্রেনেডের আঘাতে উড়ে যায়। হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী ওই হামলায় নিহত হন। স্প্লিন্টারের আঘাতে তিন শর বেশি মানুষ আহত হয়। আহতদের মধ্যে অনেকের জীবনযাপন আজও দুর্বিষহ।</p> <p>বাংলাদেশের মানুষ সিরিজ বোমা হামলার কথা ভুলে যায়নি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। ওইদিন সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে দেশের ৬৩ জেলার প্রেস ক্লাব, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও  ঢাকার ৩৪টি স্থানসহ সাড়ে চার শ স্থানে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এই হামলায় নিহত হয় দুজন এবং আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ।</p> <p>আচ্ছা আপনাদের কী মনে হয় না, গত ১৯ জুলাই নরসিংদী কারাগারে যে হামলা চালানো হয় তা স্বাধীন দেশে সম্ভব? একটি জেলার জেলা কারাগার আক্রমণ করে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কারাগারের সব বন্দিকে পালিয়ে যেতে দিল বা ছিনিয়ে নিয়ে গেল! এর মধ্যে জঙ্গি ছিল কতজন? হামলার বর্ণনায় বলা হয়, শুক্রবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে হামলাকারীরা মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে কারাগারের দুই দিকের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকে। এ সময় পেট্রলবোমা মারা হয়। কারাগারের ভেতরে নানা জায়গায় আগুন ধরে যায়। হামলাকারীরা কারারক্ষীদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া চাবি দিয়ে বন্দিদের অনেকগুলো কক্ষের তালা খুলে দেয়। কিছু কক্ষের তালা ভেঙে ফেলা হয়। চারপাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। এ সময় শুধু জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া নয়, অস্ত্রাগার ও কারারক্ষীদের থেকে ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও আট হাজার ১৫০টি গুলি লুট করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, হামলাকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। হামলা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয় কারারক্ষীরা। এই স্বাধীন বাংলাদেশে এটা কিভাবে সম্ভব?</p> <p>ইতিহাস বলে বাংলাদেশের জন্য আগস্ট কোনো সুখস্মৃতি বয়ে আনে না। বয়ে আনে দুঃখ। আর এই দুঃখ বয়ে যেন না আনতে পারে এ জন্য সরকার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। এটি আদালতের ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আগেই করা হলে দেশের জন্য আরো ভালো হতো। বর্তমান ঘটনার প্রেক্ষাপটে ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। ছাত্রদের আরো দূরদর্শী হতে হবে। তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। বিবেক দিয়ে সব কিছু অনুধাবন করতে হবে। আবেগে ভেসে গেলে দেশ ভেসে যাবে।</p> <p>লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)</p>