<p style="text-align:justify">বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে রয়েছেন। তিনি এই প্রথম চীন সফরে গেলেন এমন নয়। শেখ হাসিনা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সম্প্রতি তিন-তিনবার ভারতেও তো এসেছেন। জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি তথা ভারত সরকার বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায় দিল্লিতে আসার জন্য।</p> <p style="text-align:justify">শেখ হাসিনা এসেছিলেন। <img alt="শেখ হাসিনা দক্ষতার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করছেন" height="182" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/07.July/09-07-2024/6678.jpg" width="200" />তারপর হ্যাটট্রিক করার পর নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি দিল্লি ঘুরে গেলেন চীন সফরের কিছুদিন আগেই। তবু ভারত ও চীনের সম্পর্কের সাম্প্রতিক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠেই শেখ হাসিনার চীন সফর কিভাবে দেখছে ভারত।</p> <p style="text-align:justify">কোনো সন্দেহ নেই, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা এখন অত্যন্ত জটিল এবং বৈরিতামূলক। তবে কূটনীতিতে সব সময়ই দুই দেশের সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্পর্কে নানা স্তর থাকে। সম্পর্কের বৈরিতা বলতে গেলে তো সেই ১৯৬২ সালের চীনের যুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই ভারত-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। কিন্তু সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলেও এই সম্পর্কের চড়াই-উতরাই তো ছিলই।</p> <p style="text-align:justify">রাজীব গান্ধী চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার জন্য খুব ইতিবাচক প্রয়াস নিয়েছিলেন। আবার রাজীব গান্ধীর পর নরসিমা রাও থেকে মনমোহন সিং, নানা সময় নানা রকম চীন সফর হয়েছে। কখনো বহুপক্ষীয়, কখনো দ্বিপক্ষীয়, কখনো স্টেট ভিজিট। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদিও সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক চেষ্টা করেছেন। গুজরাটে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট শি-কে।</p> <p style="text-align:justify">সবরমতীর তীরে সেই ঝুলন কেদারায় বসে দুই নেতার কথোপকথন এবং তার ছবি ভাইরাল হওয়া এখন স্মৃতি!</p> <p style="text-align:justify">এরপর ডোকলামের ঘটনা হয়েছে। তারপর চীনের সম্প্রসারণ নীতি। ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করা, অরুণাচল সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি, এমনকি অরুণাচলের বিভিন্ন জেলায় চীনা নামকরণের প্রয়াস—এই রকম নানা সমস্যায় ভারত-চীন সম্পর্ক জর্জরিত। শুধু তো সীমান্তে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা নয়, বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও চীনের সঙ্গে ভারতের বিবাদ অনেক দিনের। বাণিজ্য ঘাটতি একটা বড় ইস্যু।</p> <p style="text-align:justify">একবার মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে চীন সফরে গিয়েছিলাম। তখন মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই বিষয়টা বেইজিং নেতৃত্বের কাছে খুব কঠোর ভাষায় তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন যে আপনারা ভারতে রপ্তানি করবেন। তার জন্য সব রকমের ছাড়পত্র আমরা দেব। অথচ আপনারা ভারত থেকে আমদানি করবেন না। অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি করার সুযোগ দেবেন না। আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে যদি বিরাট একটা ব্যবধান তৈরি হয়, তাহলেই ট্রেড গ্যাপ তৈরি হয়। সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়। এই বাণিজ্য ঘাটতিটা ভারতের দিক থেকে ভারতকেও পূরণ করার সুযোগ দিতে হবে। এখনো এই সমস্যা রয়েছে। চীনের সঙ্গে এই সমস্যা বহু দেশের রয়েছে। চীন সম্পর্কে বলা হয়, চীন যতটা নিজেদের পণ্য অন্যের বাজারে ভরিয়ে দিতে চায় এবং এতটাই ভরায় যাকে বলা হয় ডাম্পিং। কিন্তু সেভাবে অন্য দেশের পণ্য তাদের নিজের দেশে স্বাগত জানায় না।</p> <p style="text-align:justify">এবার আসা যাক বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কে। চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক সুপ্রাচীন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করল। তখন কিন্তু চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আমেরিকাও তো তখন সমর্থন করেনি। তখন সেই পরিস্থিতিটা অন্য রকম ছিল। সেই স্মৃতি মনে রেখে তো পররাষ্ট্রনীতির রূপায়ণ হয় না। পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি বদলায়। আজ যদি হিরোশিমা-নাগাসাকির পর জাপান আমেরিকার বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, ভিয়েতনামে বোমা ফেলার পরও ভিয়েতনাম চীনের জায়গায় আমেরিকার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারে, তাহলে সব সম্পর্কই আবার নতুন করে গড়ে উঠতে পারে। পাকিস্তানের মতো দেশ পর্যন্ত বাংলাদেশের সম্পর্ককে আবার নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে।</p> <p style="text-align:justify">এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শেখ হাসিনার চীন সফর। ভারত মনে করছে, এটা খুব পরিণত মনস্কতা। এবং ভারতের জন্য এটা নেতিবাচক নয়, বরং ইতিবাচক ভূমিকা বাংলাদেশ নিতে পারে। কেননা বাংলাদেশেরও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির সমস্যা রয়েছে এবং বাণিজ্যের দিক থেকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটাকে আরো শক্তিশালী ও মজবুত বাংলাদেশ করতে চাইছে। কিন্তু জিওস্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক সম্পর্ক, সেখানে ভারত এবং বাংলাদেশের যে অটুট মৈত্রী, সেখানে সেই সম্পর্ককে চীন নষ্ট করে দেবে, এমন আশঙ্কা এখনো ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে হয়নি। মুনশিয়ানার সঙ্গে শেখ হাসিনা সেই ভারসাম্যটা রক্ষা করতে পারছেন।</p> <p style="text-align:justify">বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিতেই বলা হয়েছিল যে আমরা কোনো দেশের লেজুড়বৃত্তি করব না। আবার কোনো দুটো সার্বভৌম রাষ্ট্রের ঝগড়াতে আমরা নিজেরা পার্টি হব না, আমরা একইভাবে দূরত্ব বজায় রাখব। সেই সার্বভৌম স্বাধীন বিদেশনীতি অনুসারে ভারতের সঙ্গে আবেগঘন ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে কোনো বৈরিতা বাংলাদেশ চায় না। আর ভারতও মনে করে, এই রণকৌশল ভারতের সার্বভৌম নীতির জন্য কিন্তু খারাপ নয়।</p> <p style="text-align:justify">এবার আসা যাক শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কী করতে চাইছেন? সেটাতে ভারত কী মনে করছে?</p> <p style="text-align:justify">শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বাণিজ্য বিষয়টি। সাত বিলিয়ান ডলারের একটা তহবিল তৈরি করতে উদ্যত বাংলাদেশ—এমনটাই ভারতের কাছে খবর। চীনের কাছ থেকে এই অর্থ সাহায্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে, এমনটা আশা বাংলাদেশের। কিন্তু বাণিজ্য ও বিনিয়োগের যে সম্মেলন হবে, সেই সম্মেলনে চীন ও বাংলাদেশের দুই তরফের সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার প্রতিনিধি থাকবেন। এখন চীন যে অর্থ সাহায্য বাংলাদেশকে করবে বিভিন্ন প্রকল্পে, সেগুলোর শর্ত কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বিশেষভাবে খতিয়ে দেখবে। তার কারণ, চীনের ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এবং শ্রীলঙ্কা যেভাবে হাত পুড়িয়েছে, বাংলাদেশ কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা কোনো দিন করেনি এবং বাংলাদেশ সে ব্যাপারে খুব সতর্ক। আর তাই এবার চীনের কাছ থেকে যে ঋণ নেওয়া, তার জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্য বিভাগ চারদিক থেকে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করছে। বিনিয়োগের জন্য এলসি নেওয়ার ব্যাপারেও খুব সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশ এগোচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশ বিনিয়োগ সংস্থা, উন্নয়ন সংস্থা, এক্সচেঞ্জ কমিশনার, বিএসইসি, বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রি, তাদের বিভিন্ন প্রতিনিধি বিভিন্ন দিক থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে। তবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি হলে এই উপমহাদেশে ভারতেরও লোকসানের চেয়ে লাভ বেশি। ভারতও কিন্তু চীনের সঙ্গে নতুন করে একটা আলাপ-আলোচনার রাস্তায় যেতে চাইছে। বিশেষ করে বাণিজ্যের জটিলতা থেকে মুক্ত হতে চাইছে।এ ব্যাপারে খোদ প্রধানমন্ত্রী একটি সাক্ষাত্কারে চীনের সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছিলেন ভোটের আগেই। জয়শঙ্করকে তিনি এসসিও বৈঠকেও কাজাখস্তানে পাঠিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেখানে যেতে না পারলেও জয়শঙ্কর গিয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা থেকে শুরু করে বাণিজ্য—সব বিষয়ে তাঁর খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বহুদিন পর জয়শঙ্করের একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হলো। শেখ হাসিনার চীন সফরের আগে জয়শঙ্করের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকটিও নজরকাড়া।</p> <p style="text-align:justify">আশা করা যাচ্ছে, একদিকে বাংলাদেশ যেমন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে, ভারতও কিন্তু চীনের সঙ্গে নতুন একটা অধ্যায় আলোচনা করতে চলেছে। বিশেষত আমেরিকায় এখন একটা টালমাটাল পরিস্থিতি। বাইডেন ও ট্রাম্পের দ্বৈরথ, তার নির্বাচনী পরিণতি কী হবে, সেটার দিকেও ভারত নজর রেখেছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ায় পুতিনের সঙ্গেও বৈঠক করছেন।</p> <p style="text-align:justify">সুতরাং এটা খুব স্পষ্ট যে ভারত কিন্তু ন্যাটোর সদস্যও হয়নি এবং আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছে এবং চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে ভারত বিশ্বাসী। আর ভারতের কাছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের সংস্কারসাধন খুব অগ্রাধিকার। ভারত যে রকম চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে তৃতীয় দফার মোদি জমানায়, অন্যদিকে বাংলাদেশেও জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা নব কলেবরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চীনে যাচ্ছেন। সুতরাং দুটি ভিন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্র, কিন্তু বিদেশনীতি পৃথক। তবে কোথাও একটা উপমহাদেশের স্বার্থে ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বার্থ, তার একটা সমন্বয়সাধনও কিন্তু নীরবে-নিভৃতে হয়ে চলেছে। কাজেই শেখ হাসিনার চীন সফর ভারত নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক দিক থেকেই দেখার চেষ্টা করছে।</p> <p style="text-align:justify">পুনশ্চ অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ভারত অবশ্য তাকিয়ে আছে চীন তিস্তা নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ঠিক কী প্রস্তাব দেয়! ভারত এখনো বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির রূপায়ণ করে উঠতে পারেনি। যুক্তি, ভারতের অভ্যন্তরীণ যুক্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতের কারণে এটা হচ্ছে না। শেখ হাসিনার কাছে বিকল্প প্রস্তাব এসে গেছে চীনের কাছ থেকে। অবশ্য সেই চীনের প্রস্তাব শেখ হাসিনা প্রকাশ্য সাংবাদিক বৈঠকেও জানিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও তিস্তা চুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভারত একটা সমাধান সূত্র দিয়েছে। এখন দেখতে হবে, চীন কী জানায়।</p> <p style="text-align:justify"><strong>লেখক : </strong>নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</p>