<article> <p style="text-align: justify;">ধান কেটে নেওয়ার পর বিশেষ কিছু জাতের গোড়া থেকে গজানো কুশিকে মুড়ি ধান (Ratoon rice) বলে। এই মুড়ি ধান সংরক্ষণ করলে জাত ও পরিচর্যাভেদে ৪০ থেকে ৭৫ দিনের মধ্যে আবার কিছু ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুড়ি ধান লাভজনক না হওয়ায় কৃষকরা এটিকে গুরুত্ব দেন না। তবে পৃথিবীর অনেক দেশের কৃষকরা মুড়ি ধানকে কিছুটা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">যেমন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের কৃষকরা মুড়ি ধানের আবাদ করে থাকেন, কিন্তু ফলন আশাপ্রদ নয়। ২০০৭ সালে স্থানীয় ধানবিজ্ঞানী এর্দিমানের নজরে আসে বিষয়টি। তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর গতানুগতিক মুড়ি ধান পরিচর্যাপদ্ধতিতে একটু পরিবর্তন আনেন। তিনি ধানের গোছা মাটি থেকে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার ওপরে না কেটে মাটি সমান করে কাটেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">জমিতে গতানুগতিক পদ্ধতিতে পানি জমিয়ে না রেখে শুধু ভেজা ভেজা রেখে দেন। এতে শক্ত এবং পুষ্ট কুশি বের হয়। তারপর প্রধান ফসল থেকে কম সময়ে দ্বিতীয় ফসল (প্রথম মুড়ি) কাটা সম্ভব হয়। এই দ্বিতীয় ফসল থেকে একই পদ্ধতিতে তৃতীয় ফসল (দ্বিতীয় মুড়ি)) করা হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এভাবে একবার রোপণ করে বছরে সাতবার পর্যন্ত ধান কাটা সম্ভব হয়। প্রতিবারে গতানুগতিক মুড়িপদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক ভালো ফলন পাওয়া যায়। এখন পশ্চিম সুমাত্রার চাষিরা এর্দিমানের দেখানো পথে মুড়ি ধানের চাষ করছেন। ওখানে প্রযুক্তিটি SALIBU নামে পরিচিত।</p> <p style="text-align: justify;">JIRCAS -এর সহায়তায় জাপানি বিজ্ঞানীরা ঐতিহ্যবাহী SALIBU প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও মিয়ানমার ও ঘানায় কাজ করেছেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী উদ্ভাবিত এই ধরনের একটি ধানের জাত নিয়ে বেশ আলাপ-আলোচনা চলছে। বোরো মৌসুমে রোপণের ১১০ দিন পর জাতটির প্রথম ফসল কাটা পড়ে। এরপর ধানগাছের গোড়া থেকে কুশি গজানোর ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর আরো কিছু ধান পাওয়া যায়। সাধারণ মুড়ি ধানের দৌড় এ পর্যন্তই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবকের দাবি মোতাবেক বোরোর (হেক্টরপ্রতি ফলন চার টন) পরে আউশে দুইবার (তিন টন + দুই টন) এবং আমনে দুইবারসহ (দুই টন + দুই টন) বছরে মোট পাঁচবার ধান পাওয়া সম্ভব। মুড়ি ধান নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে ১৯৫০ সাল থেকে গবেষণা হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটেও (ব্রি) বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) ১৯৮০-এর দশকের আগে-পরে মুড়ি ধান নিয়ে বেশ কিছু কাজ করে, কিন্তু ফলপ্রসূ কিছু করা যায়নি। অতঃপর ইরির বিজ্ঞানী ক্যালেন্ডাসিয়ন ও তাঁর সহযোগীরা (১৯৯২) গতানুগতিক মুড়ি-প্রযুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে লক-লজিং নামের এক বিশেষ কৌশল উদ্ভাবন করেন। এই প্রযুক্তির ব্যবহারে গতানুগতিক পদ্ধতির চেয়ে প্রায় দুই গুণ ফলন বেশি পাওয়া গেলেও ফিলিপাইনের চাষিরা সেটি গ্রহণ করেননি। এর পরপরই (উন্নততর মুড়ি-প্রযুক্তির লক্ষ্যে) বহুবর্ষজীবী ধান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ইরির বিজ্ঞানীরা (স্যাক ও তাঁর সহযোগীরা, ২০০৬)। তাঁরা জংলি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত কন্দসমৃদ্ধ  (Rhizomatous) জংলি ধানের জাতের ( Oryza longistaminata)  সঙ্গে Oryza sativa -এর সংকরীকরণের ফলে উদ্ভূত প্রজন্ম নিয়ে মৌলিক গবেষণা শুরু করেন। উল্লেখ্য, মুড়ি ধান এবং বহুবর্ষজীবী ধানের মধ্যে কৌলিতাত্ত্বিক ও কৃষিতাত্ত্বিক ভিন্নতা আছে। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পরে ২০০১ সালে বাজেট স্বল্পতার অজুহাতে এই গবেষণা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চীনা বিজ্ঞানী হু ফেঙ্গুই (বর্তমানে জুনান একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সের উপপরিচালক) দেশে ফিরে এই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি ও তাঁর সহযোগী Oryza longistaminata-এর সঙ্গে স্থানীয় উফশী জাতের সংকরী করে কিছু কৌলিক সারি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। এসব কৌলিক সারি থেকে উদ্ভাবিত তাঁদের কিছু জাত এখন কৃষকরা চাষ করছেন। তাঁরা কন্দ-বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিনগুচ্ছ</p> <p style="text-align: justify;"> শনাক্ত করতে সক্ষম হন। তাঁদের এ কাজ এখনো চলমান। বিশ্বের অনেক দেশে তাঁরা তাঁদের প্রযুক্তি সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন। জুনান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (IUBAT- International  University of Business Agriculture and Technology)  কয়েক বছর ধরে বহুবর্ষজীবী ধান নিয়ে কাজ করছে। এসব গবেষণার ফলাফল দেখে আমার মনে হয়েছে যে বহুবর্ষজীবী বা মুড়িজাতীয় ধানের জন্য শুধু জাতটিই নয়, পরিবেশ ও পরিচর্যা সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমাদের দেশে ড. চৌধুরী উদ্ভাবিত উপর্যুপরি-মুড়ি-প্রযুক্তি বা পঞ্চব্রীহি ধান নিয়ে অনেকেই খুব আশাবাদী। এ ব্যাপারে তিনি কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনার দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার উপযোগিতা প্রমাণের জন্য তাঁর প্রথমেই উচিত ছিল ব্রিতে একটি সেমিনার দেওয়া। তাহলে এই প্রযুক্তির প্রায়োগিক দিকগুলো পরিষ্কার হতো। কারণ কোনো কৌলিক সারি উদ্ভাবন করলেই চলে না। কৃষকের উপযোগী করতে হলে কৃষকবান্ধব, পরিবেশবান্ধব, ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাবনটি ‘যুক্তিগ্রাহ্য-উদ্ভাবন’ (Rational invention) হতে হবে। তবেই না সেটি জাত হিসেবে অবমোচন করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে ব্রির পক্ষ থেকে আগ্রহের কমতি ছিল না, কিন্তু ড. চৌধুরীর পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। অতএব তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয়।</p> <p style="text-align: justify;">বছর আটেক আগে (সম্ভবত ২০১৭ সালে) কানিহাটি-১, কানিহাটি-২, কানিহাটি-৩ (কানিহাটি সিরিজ) ইত্যাদি কিছু বোরো ধানের কৌলিক সারি উদ্ভাবনের নামে তিনি  কৃষি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাঁর দাবি মোতাবেক জাতগুলো ছিল মাত্র ১২০ দিনের। তাহলে হাওরে রোপণ করলে নিশ্চিত বৈশাখী ঢলের আগে আগে কাটা পড়ার কথা। বাংলাদেশের ধানবিজ্ঞানীরা সেই ১৯৩৪ থেকে চেষ্টা করে আসছেন একটি স্বল্পজীবনকালীন বোরো ধানের জাত আবিষ্কারের। পারেননি। অবশেষে  ১৯৯৪ সাল ও তার পরের কিছু উদ্ভাবিত উফশী জাত; যেমন—ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৩৬, ব্রি ধান ৪৫, যাদের জীবনকাল ১৪০ দিন বা অল্প কিছু বেশি। ২০১৭ সালের পরে অবমুক্তকৃত কিছু জাতের জীবনকাল ব্রি ধান২৮-এর মতো হলেও ফলন হেক্টরপ্রতি এক থেকে দেড় টন বেশি। ঠিক এমনই সময় মন্ত্রণালয় থেকে কানিহাটি সিরিজের কৌলিক সারিগুলোর ফলন পরীক্ষা করার আদেশ আসে। ব্রি যথারীতি আদেশ পালন করে। দুঃখের বিষয়, ওই পরীক্ষা কার্যক্রমে কানিহাটি নামের কৌলিক সারিগুলো থেকে আশানুরূপ কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এমনকি দাবিকৃত জীবনকাল সম্পর্কেও না। কারণ জানুয়ারিতে রোপণ করা (তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত) জাতগুলোর জীবনকাল কোনোক্রমেই ১৪০ দিনের নিচে আসার কথা নয়। তবে ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে (দেরিতে রোপণ) রোপণ করলে জীবনকাল কমে এলেও মে মাসের শেষে ধান কাটা পড়বে; ফলন কমে যাবে। অর্থাৎ অন্য জায়গায় কিছু ফলন পাওয়া গেলেও হাওরের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। তাই ব্রির বিজ্ঞানীরা কানিহাটি সিরিজের কৌলিক সারিগুলোর পক্ষে দাবিকৃত ফলের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। ড. চৌধুরীর এই বিষয়গুলো অজানা থাকার কথা নয়। এ কারণে তিনি ব্রির বিজ্ঞানীদের ওপর ভরসা করতে পারছেন না।</p> <p style="text-align: justify;">পরিশেষে বলতে হয়, আমাদের দেশে মুড়ি ধান করতে হলে বন্যামুক্ত জমি দরকার। আর পঞ্চব্রীহির জন্য দরকার শীত-গ্রীষ্মের অতিরিক্ত প্রভাবমুক্ত পরিবেশ, যেখানে সারা বছর ধান করা যায়। অর্থাৎ ধান-ধান-ধান শস্যক্রমের উপযোগী উঁচু জমি। এমন জমির পরিমাণ</p> <p style="text-align: justify;">Neat Cropped Area -এর আড়াই শতাংশেরও কম। দুই লাখ ৯ হাজার ১৫ হেক্টর মাত্র। তা দিয়ে আমাদের খাদ্যসংকট পূরণে যা লাভ হবে, তার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। কারণ জাতগুলোর বালাই প্রতিরোধী ক্ষমতা মোটেই টেকসই হতে পারে না। বছরজুড়ে একই জাতের মুড়ি ফসল চাষ করলে বালাই পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে হতে ভয়ানক আকার ধারণ করবে। আমাদের দেশ ছোট। বন্যাপ্রবণ। আমাদের চাই অল্প জমিতে বেশি উৎপাদন, বেশি প্রোটিন, বেশি কর্বোহাইড্রেট এবং বেশি পুষ্টি উপাদান। পাশাপাশি মৃত্তিকার স্বাস্থ্য রক্ষাও একটি জরুরি বিষয়। চীন বা ইন্দোনেশিয়ার মতো পরিবেশ আমাদের নেই, অঢেল জমিও নেই। এর চেয়ে তিন মৌসুমের (হেক্টরপ্রতি আট টন + চার টন + পাঁচ টন) উপযোগী ব্রির সাম্প্রতিককালের তিনটি জাত চাষ করলে তথাকথিত পঞ্চব্রীহির চেয়ে বছরে হেক্টরপ্রতি তিন-চার টন ফলন বেশি পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বালাই পরিস্থিতি অনুকূলে থাকবে। পছন্দ মোতাবেক ধানের আবাদ করা যাবে। তাই পঞ্চব্রীহি সামাজিক মাধ্যমের খোরাক হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের খোরাক জোগানোর জন্য আরো অনেক পথ হাঁটতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;"><b>লেখক : </b>সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন</p> </article>