<article> <p style="text-align: justify;">স্বাধীনতা, উন্নয়ন, শিক্ষা, প্রশাসন, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক মূল্যবোধ, সুশাসন, রাষ্ট্রের দর্শনসহ এমন কোনো বিষয় নেই, যা বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা যায়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করানো। কাজটি খুবই দুরূহ ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর একটি অন্যতম গুণ ছিল তিনি কাকে দিয়ে কী কাজ হবে, তা বুঝতে পারতেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তিনি এটিও বুঝেছিলেন, একটি দেশের স্বাধীনতাকে যদি অর্থবহ করে তুলতে হয়, তাহলে প্রয়োজন একটি দক্ষ প্রশাসন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে বাঙালির পক্ষে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অংশ হওয়া অনেকটাই অসম্ভব ছিল। যে কজন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে ছিলেন, তাঁদের একটি বড় অংশ ছিল পাকিস্তানি ভাবধারার। বঙ্গবন্ধু এটিও জানতেন দেশের প্রশাসনকে যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে প্রশাসনে জন্ম দিতে পারে একটি ভয়ংকর আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা একসময় দানবীয় রূপ ধারণ করে জনগণকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে খোদ রাষ্ট্রটিকেই তছনছ করে দিতে পারে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আমলারা যখন নিজেদের মতবাদ ও চিন্তা-চেতনাকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপিয়ে দেন, তখনই জন্ম হয় ভয়াবহ আমলাতন্ত্রের। আমলাতন্ত্র সম্পর্কে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য। প্রণব মুখোপাধ্যায় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের আহমেদাবাদে অবস্থিত প্রখ্যাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে বলেছিলেন, ‘আমলাতন্ত্র আমাদের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা, যা আমাদের সংস্কার করতে হবে।’ ভারতীয় আমলাতন্ত্রের মূল্যায়ন করতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে যোগ্য আর কেউ হতে পারেন না। তিনি এই আমলাতন্ত্রের তিন কাল দেখেছেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের আমলারা কিছু অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারকে প্ররোচিত করেন এবং তার মাধ্যমে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বা পেশাজীবীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। যেখানে কোনো সমস্যা নেই, সেখানে তাঁরা সমস্যা সৃষ্টি করেন। বর্তমানে এমন একটি সিদ্ধান্ত দেশের শিক্ষকসহ সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকটা সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাদ গেছেন শুধু আমলারা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কারণ তাঁরাই এই সিদ্ধান্তুের মূল কারিগর। সিদ্ধান্তটি কথিত ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম’ নিয়ে, যার বাহারি নাম ‘প্রত্যয়’। উল্লেখ্য, গত ১৩ মার্চ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেসব শিক্ষক/কর্মকর্তা/কর্মচারী ১ জুলাই ২০২৪ তারিখের পর চাকরিতে যোগদান করবেন, তাঁদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যুক্ত করে নেওয়া হবে।</p> <p style="text-align: justify;">লাখ লাখ তরুণ বিসিএস ক্যাডারে (প্রশাসনিক) যোগ দেওয়ার জন্য নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। এটি একটি খবর তো বটেই। কিন্তু আরো একটি খবর হচ্ছে, প্রতি পরীক্ষায় একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরীক্ষার্থী থাকে, যারা আগে থেকেই অন্য ক্যাডার সার্ভিসে কর্মরত। তারা দেখেছে প্রশাসনিক ক্যাডারের আমলারা শুধু সরকারি কর্মচারীই নন, তাঁরা সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে থেকে সরকারকে নিজেদের ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে পারেন। এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই, যা তাঁরা ভোগ করেন না। নিজের ও পরিবারের জন্য বিনা সুদে সরকারি তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনা, জ্বালানির জন্য মাসিক বরাদ্দ, ড্রাইভারের বেতনের মতো আরো অনেক সুবিধা তো আছেই, তার ওপরে আছে অবসরের পর বিভিন্ন ব্যাংক বা করপোরেশনের চেয়ারম্যান, বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্যসহ এমন কোনো সরকারি পদ-পদবি নেই, যার দ্বার তাদের জন্য উন্মুক্ত নয়। বিভিন্ন সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ আমলাদের জন্য সংরক্ষিত আছে।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/02-06-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" height="327" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/02-06-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" width="350" />গত সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বিদেশে যত বেগমপাড়া আছে, তার বেশির ভাগেরই বাসিন্দা সাবেক আমলা। এসবের ওপর আছে পরিবারের সদস্যদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা। সম্প্রতি ডিসি সম্মেলনে প্রস্তাব করা হয়েছে আমলাদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করার, যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ৫৭ জন কর্মকর্তা বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে পরীক্ষার জন্য চাকরি ছেড়েছেন। অর্থনৈতিক ক্যাডারে নাকি মাত্র ১৫ জন কর্মকর্তা কর্মরত। </p> <p style="text-align: justify;">দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করি। ২০১৫ সালে সরকার অষ্টম পে স্কেল ঘোষণা করে জানিয়ে দিল, সরকারি সব ক্যাডার সার্ভিসের (পড়তে হবে প্রশাসনিক) সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ২৫ শতাংশ যে সিলেকশন গ্রেড (একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের শেষ স্কেল) দেওয়ার আইন আছে, তা বাতিল করা হয়েছে। তাঁরা নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষকের তুলনায় অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি, যার ফলে এই ব্যবস্থায় সরকারের বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। স্বাভাবিকভাবেই শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন। সব শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকার ও শিক্ষকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার এই অমর কীর্তির পেছনে অবধারিতভাবে আছেন এই আমলাকুল। ফলে শিক্ষকরা বাধ্য হয়েছেন রাস্তায় নামতে।</p> <p style="text-align: justify;">এক সরকারি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমার কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন। তাঁকে আমি বিনীতভাবে এ সম্পর্কে আমার অজ্ঞতার কথা জানাই এবং বলি, এই বিষয়ে আমার সঙ্গে কেউ আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেনি। তিনি একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। রাতে এক জাঁদরেল আমলা ফোন করে পরদিন আমার সঙ্গে এক সভার কথা জানালেন। সেই সভা হলো। উপস্থিত পাঁচজন সদস্য আর আমরাও পাঁচজন। ঠিক করে নিয়েছিলাম আমিই কথা বলব। বিষয় শিক্ষকদের আন্দোলন। আমার এক সহকর্মী তথ্য-উপাত্ত দিয়ে স্পষ্ট করে দিলেন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কী কী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। আর বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান কোথায়। পরদিন সেই আমলাদের জানিয়ে দিলাম, এই সুবিধা ২৫ শতাংশ শিক্ষক নয়, শুধু অধ্যাপকদের জন্য প্রযোজ্য, যা শুধু পুরনো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ভোগ করবেন। অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে পাঁচ থেকে সাতজন সহকারী অধ্যাপকের বাইরে ওপরের পদে কোনো শিক্ষকই নেই। বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অধ্যাপক এই সুবিধা ভোগ না করেই অবসরে যাবেন। তাঁদের নানা পরিসংখ্যান দিয়ে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিই কত শতাংশ হলে কত টাকার সংশ্লেষ হবে। সব শেষে ১৯৮৭ সালের একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন বের করি, যাতে অধ্যাপকদের এই সিলেকশন গ্রেড দেওয়ার কথা আলাদা করে বলা আছে। সে রাতেই সব সমস্যার সমাধান করে দেন প্রধানমন্ত্রী। শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে যান।</p> <p style="text-align: justify;">দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করার জন্য বঙ্গবন্ধু সংসদে বিশেষ আইন পাস করে ১৯৭৩ সালে গঠন করেছিলেন বিধিবদ্ধ সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। ৫০ বছরের ব্যবধানে এই কমিশনকে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করার দাবি বহুদিনের। চেষ্টা করা হয়েছে কয়েকবার। আটকে গেছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ আছে। পুরো প্রস্তাব যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গেল সচিব কমিটিতে। কমিশনের সিনিয়র কর্মকর্তারা সেখানে নিয়মমাফিক হাজিরা দেন। সব শেষে প্রত্যাশিত কমিশন প্রস্তাব না করে প্রস্তাব করা হয় একটি ‘আমলা পুনর্বাসন’ কমিশন। চেয়ারম্যান বা সদস্য হতে পারবেন কর্মরত বা অবসরে যাওয়া আমলা। প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে আবেদন-নিবেদন করে তার বাস্তবায়ন বন্ধ করা হয়। সবাইকে বুঝিয়ে বলি, এমনটি হলে তা হবে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি চরম অবমাননা। এই প্রস্তাবিত কমিশন বাস্তবায়িত হলে পরদিন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে যেত।</p> <p style="text-align: justify;">বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছিলেন বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে, যাঁদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন শিক্ষক আর কয়েকজন সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য। অবসরে ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সৈয়দ আনোয়ারুল করিম (পররাষ্ট্রসচিব) ও মতিউল ইসলাম (অর্থসচিব)। তাঁদের ডেকে এনে তিনি কাজে লাগান। তবে পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিও আমলাতন্ত্রের শিকার হন। ১৯৭৪ সালের খাদ্যসংকট একটি আন্তর্জাতিক ষড়ন্ত্রের ফল হলেও এখানে মতলবি আমলাতন্ত্র তা সংকটে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তখন খাদ্যসচিব ছিলেন আব্দুল মোমেন খান (বিএনপি নেতা ড. মঈন খানের বাবা)। পরবর্তীকালে তিনি জিয়ার উপদেষ্টা ও মন্ত্রী হয়েছিলেন।</p> <p style="text-align: justify;">আমাদের স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমাদের আমলাতন্ত্রের কোনো সংস্কার বা জনবান্ধব আমলা তৈরি করার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে সব সরকারই ব্যর্থ হয়েছে। এখনো আমাদের প্রশাসনিক আমলারা শুধু পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা ও ঔপনিবেশিক আমলের চিন্তা-চেতনা লালন করেন।</p> <p style="text-align: justify;">গত ১৫ বছরে দেশে একটি ধারণা প্রচলিত হয়েছে যে উদ্ভূত সব সমস্যার সমাধানের জন্য দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন ধারণা করা সমীচীন নয়। একজন প্রধানমন্ত্রীর আরো অনেক সুদূরপ্রসারী সমস্যার কথা চিন্তা করতে হয়। তাহলে আমলাদের কাজ কি কেবল সরকারের জন্য নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা? অবশ্য এটি স্বীকার করতেই হয়, সরকারে অনেক দক্ষ, সৎ, যোগ্য ও জনবান্ধব প্রশাসনিক আমলা আছেন, যাঁদের কারণে সরকার নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মেকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। এই আমলাদের কদাচিৎ মূল্যায়ন করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">সময় হয়েছে দেশে একটি স্বাধীন দেশের জন্য উপযুক্ত ক্যাডার সার্ভিস তৈরির উদ্যোগ নিয়ে পুরো ক্যাডার সার্ভিসকে সংস্কার করার, যা দেশে একটি জনবান্ধব প্রজাতন্ত্রের সেবক আমলাতন্ত্র উপহার দেবে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>বিশ্লেষক ও গবেষক</p> </article>