<article> <p style="text-align: justify;">সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্যের আগে আমরা বাংলাদেশে জাতীয় গণমাধ্যমে চাঁদ দেখার খবরের অপেক্ষায় থাকতাম। রেডিও-টিভিতে যখনই ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ’ গানটি শুরু হতো, তখনই আমরা ধরে নিতাম পরদিন ঈদ। কাজী নজরুল ১৯৩১ সালে গানটি রচনা করেন। ১৯৩২ সালে প্রথম আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গানটি রেকর্ডিং কম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এর পর থেকেই বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছে এই গানটি ছাড়া রমজানের ঈদ ছিল অসম্পূর্ণ। রোজার শেষে চাঁদ দেখার খবর এবং এই গানের মধুর সুর ছিল অনেকটা সমার্থক। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় সব খবরই ঘুরে বেড়ায়। তাই হয়তো এই গানের মাধ্যমে চাঁদ দেখার বার্তা সবার কাছে আগের মতো পৌঁছায় না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তবু আমরা যারা এই গানের মাধ্যমে ঈদের আগমনী সংবাদ পেয়ে বড় হয়েছি, তারা আজও ঈদের আগের রাতে গুনগুন করে গাইতে থাকি—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...।’</p> <p style="text-align: justify;">যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মতো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো চাঁদ দেখা কমিটি নেই। মুসলমানরাও সবাই বাংলাভাষী নয়। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলমানরা তাদের নিজ নিজ দেশের চর্চিত প্রথা অনুযায়ী রোজা রাখা শুরু করে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ঈদ উদযাপন করে। এতে দেখা যায়, চাঁদ দেখার ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন দিনে ধর্মীয় উৎসবগুলো পালিত হচ্ছে। আরব মুসলমানরা মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে একই দিনে ঈদ ও রোজা পালন করে থাকে। তাই তাদের আত্মীয়-স্বজনকে একই দিনে ধর্মীয় উৎসব পালনে কোনো সমস্যা হয় না, যদিও পুরো মুসলিম বিশ্ব একসঙ্গে ঈদ পালন করতে পারে না—একক হিজরি ক্যালেন্ডার গৃহীত না হওয়ার কারণে। সমস্যা হয় বাংলাদেশি আমেরিকানদের ক্ষেত্রে।</p> </article> <p style="text-align: justify;">যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিরা মোটাদাগে ধর্মীয় উৎসব পালনে দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশ আরব মুসলমানদের সঙ্গে রোজা রাখে এবং ঈদ করে থাকে। আরেক অংশ স্থানীয় আকাশে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোজা রাখে এবং ঈদ করে। এতে দেখা যায়, কখনো কখনো একই দিনে ঈদ করা সম্ভব হয় না।</p> <article> <p style="text-align: justify;">এবারের রোজাও এ জন্য বাংলাদেশি মুসলিম কমিউনিটি একই দিনে শুরু করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের বড় অংশ রোজা শুরু করেছে ১১ মার্চ সোমবার থেকে। অন্য একটি গ্রুপ শুরু করেছে পরদিন মঙ্গলবার থেকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আমরা ঈদও করতে যাচ্ছি দুই দিনে, দুই গ্রুপে? আমাদের পছন্দ না হলেও হয়তো তা-ই হবে।</p> <p style="text-align: justify;">২০১৬ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে ইন্টারন্যাশনাল হিজরি ক্যালেন্ডার ইউনিয়ন কংগ্রেসের সম্মেলনে সারা পৃথিবীতে একই দিনে রোজা ও ঈদ পালনের বিষয়ে মুসলিম বিজ্ঞানী ও ইসলামিক স্কলাররা একমত হন। সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন,  যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি মুসলিম দেশের স্কলাররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে তাঁরা আবারও মিলিত হয়েছেন। সবাইকে নিয়ে একক হিজরি ক্যালেন্ডার প্রণয়নে তাঁরা কাজ করছেন। হয়তো ভবিষ্যতে কোনো এক সময় ওআইসির মাধ্যমে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আসতেও পারে। মুসলিম বিশ্বের সবাইকে সেই অনাগত দিনের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।</p> <p style="text-align: justify;">গত বছর রোজার ঈদের দিনে আমার ছেলেমেয়েরা বড় বড় গিফট প্যাকেট নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিল। গিফট প্যাকেটে বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় আইটেম ছিল। শুধু আমার ছেলেমেয়ে নয়, তাদের সব কাজিনের কাছেই এ রকম প্যাকেট ছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তাদের সবার আরেক কাজিন সাদিয়া, যে এ বছরই ভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, তারই উদ্যোগে এই আয়োজন। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই সে ডজনের ওপর কাজিনের জন্য বিভিন্ন আইটেমের গিফট দিয়ে যার যার গিফট প্যাকেট তৈরি করেছে। হঠাত্ কেন সে এই আয়োজন করেছে জিজ্ঞেস করলে জানাল, এ দেশে সবাই স্কুলে যাচ্ছে, যেখানে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে শুধুই ক্রিসমাস ডের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এখন তাদের কাছে ঈদকে আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারলে তারা আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ভুলে যাবে।</p> <p style="text-align: justify;">এখন যদি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটের কথা বিবেচনা করি, তাহলে আরো অনেক সমস্যা সামনে আসবে। এই স্টেটের প্রথম সিটি ডিয়ারবনে গত বছর ঈদের ছুটি কার্যকর করা হয়েছে। হ্যামট্রামিক সিটির মেয়রও আরব মুসলমান। কাউন্সিলম্যানরা মুসলমান। হয়তো হ্যামট্রামিকে এবারও ঈদে ছুটি কার্যকর হবে। এরপর যে শহরে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বৃদ্ধি পাচ্ছে তার নাম ওয়ারেন সিটি। মজার বিষয় হচ্ছে যে ওয়ারেন সিটিতে বাংলাদেশি মুসলমানরা বাড়ছে। আগের দুই সিটিতে আরব মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাদের পক্ষে একই দিনে ছুটি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে ওয়ারেনে বাংলাদেশি মুসলমানরা বৃদ্ধি পেলেও ছুটি বাস্তবায়ন কঠিন হবে যদি আমরা একই দিনে ঈদ করার বিষয়ে একমত হতে না পারি।</p> <p style="text-align: justify;">একটু উদার হলেই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে একই দিনে সবাই ঈদ করে আমাদের শিশু-কিশোরদের কণ্ঠে তুলে দিতে পারি কাজী নজরুলের সেই গান—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ নতুবা যুক্তরাষ্ট্রে রোজার শেষে ঈদের চাঁদ হয়ে উঠবে আনন্দের পরিবর্তে বিতর্ক ও বিভক্তির ইস্যু।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক :</strong> রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র</p> <p style="text-align: justify;">mahmudpukra@gmail.com</p> </article>