<article> <p align="left">দুনিয়ার জটিলতা বোঝার আগেই সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল দুধের শিশু সাইফুল ইসলামকে। মা-বাবার মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। একপর্যায়ে মনের অমিল গড়ায় বিচ্ছেদে। তখন সবে আড়াই বছরের শিশু সাইফুল। সেই থেকে বাবা আর কোনো খোঁজ নেননি সাইফুল কিংবা তাঁর মা রিনা বেগমের। পরে মায়ের সঙ্গে সাইফুলের ঠিকানা হয় নানা আক্কাস আলীর বাড়ি।</p> </article> <article> <p><img alt="দারিদ্র্য জয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে" height="74" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/06-04-2024/770.jpg" style="float:left" width="258" />নেত্রকোনার পূর্বধলার পূর্ব ভিকুনিয়া গ্রামে সাইফুলের নানাবাড়ি। হাঁপানি রোগী নানা আক্কাস আলীর নিজেরই চলা দায়। ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। দুই ছেলেও দিনমজুরি করে চলেন। তাই হঠাৎ করে জুড়ে বসা দুটি মুখের আহার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হতো আক্কাস আলীকে। কুঁড়েঘরে চরম অনটনের মধেই বড় হতে থাকেন সাইফুল। তবে হাল ছাড়েননি মা রিনা বেগম। ছেলেকে যোগ্য মানুষ করে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তাঁর। অশেষে দুঃখের প্রহর পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্নেরা পাখা মেলেছে। চরম দারিদ্র্যের পাহাড় ঠেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সেই সাইফুল সুযোগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটে মেধাতালিকায় ৭২তম হয়েছেন তিনি। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ই’ ইউনিটেও মেধাতালিকায় ১৫৪তম হয়েছেন। ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটেও।</p> <p><strong>মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন</strong></p> </article> <article> <p align="left">ছেলের এই সাফল্যে মা রিনা বেগমের চোখ ভরেছে খুশির জলে। ‘হুতের (ছেলের) দিকে চাইয়া নিজের সুখ বাদ দিছি। অভাবের কারণে ওরে ভালো জামাকাপড় দিতে পারি নাই। অহন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইছে, আমার কষ্ট সার্থক হইছে’, বললেন সংগ্রামী এই মা। অন্যের বাড়িতে কাজ করে অনেক কষ্টে ছেলের পড়ালেখা চালিয়ে নিয়েছেন তিনি। লোকের বাড়িতে ক্ষেতের ধান সিদ্ধ করা, মাথায় করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যে করেননি। এনজিও থেকে পাওয়া একটি গরুও পালতেন। বিবাহবিচ্ছেদের সময় রিনা বেগমের বয়স ছিল মাত্র ২৫। প্রতিবেশীদের অনেকেই বলেছিল আবার বিয়ে করতে। কিন্তু আগ্রহ পাননি তিনি। নিজের সুখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে চেয়েছিলেন একমাত্র ছেলেটিকে মানুষ করতে।</p> <p align="left"><b>লেখাপড়ায় দারুণ মনোযোগী</b></p> <p align="left">পূর্বধলার পূর্ব ভিকুনীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে পিইসি পাস করেন সাইফুল। পরে ভর্তি হন সাধুপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর পর অনেকেই তাঁকে বলেছিল—গরিব মানুষ, পড়াশোনা করে লাভ নেই। তোর মা কাজ করে খায়। তুইও কোথাও কাজে লেগে যা।</p> <p align="left">কিন্তু সাইফুল কিশোর বয়সেই বুঝেছিলেন, পরের বাড়িতে কাজ করা মায়ের কষ্ট। এটাও বুঝে গিয়েছিলেন—লেখাপড়া করে মানুষ হওয়া ছাড়া মা-ছেলের কষ্ট দূর করার আর কোনো উপায় নেই। তাই ঠিক করেছিলেন, যতই কষ্ট হোক, পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। সেই জেদ থেকে মায়ের সঙ্গে নিজেও অন্যের বাড়িতে খেটেছেন। দিনমজুর হিসেবে অন্যের ক্ষেতে ধান লাগানো, ধান কাটাসহ নানা কাজ করেছেন।</p> <p align="left">অষ্টম শ্রেণিতে উপবৃত্তি পেয়েছিলেন সাইফুল। এর সঙ্গে মায়ের জমানো টাকা দিয়ে জেএসসির ফরম পূরণ আর পরীক্ষার আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়েছেন। দূর সম্পর্কের এক মামাতো ভাই তাঁকে বিনা পয়সায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে জেএসসি পর্যন্ত প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন। জেএসসিতে জিপিএ ৪.৭১ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সাইফুল। পরে এসএসসি ও এইচএসসি দুটিই উত্তীর্ণ হয়েছেন জিপিএ ৫ পেয়ে।</p> <p align="left"><b>দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই</b></p> <p align="left">ভালো জামাকাপড়, জুতা, স্কুলব্যাগ সাইফুলের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। মাকে দেখতেন, মাসের পর মাস এক কাপড়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন। সাইফুল বললেন, ‘বন্ধুরা বিভিন্ন উৎসবে নতুন পোশাক পরত। মা আমাকে তা কিনে দিতে পারতেন না। তখন খুব কষ্ট লাগত।’ তবে মায়ের কষ্টের কথা মনে হলে চোখ মুছে আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দিতেন তিনি। এসএসসির ফরম পূরণ করার টাকা ছিল না। সময় চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি জেনে সহায়তা করে দিলরুবা হাবিব শিক্ষা ফাউন্ডেশন। এসএসসির পর ভর্তি হন পূর্বধলা সরকারি কলেজে। এলাকার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্র শ্যামল চন্দ্র তাঁকে খোঁজ দেন চ্যারিটি সংগঠন ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর। তারা সাইফুলকে কলেজে ভর্তির অর্থ দেয়। এভাবেই বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা এবং নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছেন সাইফুল।</p> <p align="left"><b>সুযোগ পেয়েছেন সবগুলোতেই</b></p> <p align="left">নানাবাড়িতে একটিই ঘর ছিল। ঘরের অন্যদের কথাবার্তার মধ্যেই খুব কষ্টে মনোযোগ ধরে রেখে পড়তেন সাইফুল। কিন্তু এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়। তাই আবারও গ্রামের বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শ্যামলের দ্বারস্থ হলেন। ঢাকায় কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিংয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। কারণ তাঁর পক্ষে ভর্তি কোচিং করার মতো টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত ঢাকার মোহাম্মদপুরের ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ভর্তি কোচিংয়ের সুযোগও পেলেন। ঢাকায় হোস্টেলে থাকা-খাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরমসহ সব খরচ দিয়েছে ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। সাইফুল বললেন, ‘কখনো পড়াশোনায় মন না বসলে মায়ের কষ্টের কথা চিন্তা করতাম। মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিতাম—মা আমাকে মানুষ করার জন্য অনেক কষ্ট করছেন। তাই মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য আমাকেও চেষ্টা করতে হবে। হোস্টেলে থাকার সময় খুব কষ্টে মা আমাকে চার-পাঁচ শ টাকা পাঠাতেন। তা দিয়ে খাতা-কলম কিনতাম।’ এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন সাইফুল।</p> <p align="left">২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন সাইফুল। সুযোগ পেয়েছেন সবগুলোতেই। এ সাফল্যের জন্য নিজের শিক্ষক, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনসহ অনেকের কাছেই ঋণ স্বীকার করেন সাইফুল। আর অতি অবশ্যই মা। ‘মা আমার জন্য অনেক করেছেন। তাঁর কষ্ট, দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব আমার পড়ালেখার ইচ্ছা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হতে চাই। চাই আমার মতো যারা অসহায়, তাদের পাশে দাঁড়াতে’, বললেন দারিদ্র্যজয়ী এই অদম্য তরুণ।</p> </article>