<article> <p style="text-align: justify;">হাওর এলাকায় পাহাড়ি ঢলের স্বাভাবিক সময় চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ১৫০ দিন জীবনকালের বেশির ভাগ ধান কাটা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নাবি করে লাগানো বেশি বয়সের চারার ফসল (বা জীবনকাল যদি ১৫০ দিনের বেশি হয়) স্থান-কাল ভেদে এই ‘বৈশাখী ঢল’-এ ধরা খেতে পারে। কারণ বৈশাখের প্রথমে না হলেও শেষের দিকে তো ‘ঢল’ আসার সমূহ সম্ভাবনা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এটাই হাওর এলাকার চাষিদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এ নিয়মের যে ব্যত্যয় ঘটে না, এমন নয়। যেমন—১৪২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্রের মাঝামাঝি (২০১৭ সালে মার্চের শেষ সপ্তাহ) সময়ে নেমে আসে ‘আগাম ঢল’। যেটাকে ‘চৈতালি ঢল’ বলা চলে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সে ঢলের সময় এবং প্রখরতাও অস্বাভাবিক ছিল। আগাম জাতের (ব্রি ধান২৮) ধানও তখন পাকার পর্যায়ে আসেনি। ফলে ওই এলাকায় চাষি এবং জীববৈচিত্র্য এক মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়ে।</p> <p style="text-align: justify;">সাধারণ বিচারে ধান উৎপাদনের জন্য হাওর একটা বৈরী পরিবেশ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তাই হাওরে ধানের চাষ মোটেই সহজ নয়। চাষিরা সাধারণত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে কার্তিকের ‘শেষ-চান্দে’ ‘জালা’ (বীজতলায় বীজ ফেলা) ফেলেন। দিনে দিনে জমি জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চাষিরা ধান রোপণ করতে থাকেন। এ জন্য কৃষিবিজ্ঞানীদের পরামর্শ মোতাবেক রোপণের সময় এবং চারার বয়স ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। ফলে ব্রি ধান২৮-এর <img alt="হাওরের চৈতালি ও বৈশাখী ঢল নিয়ে কিছু কথা" height="214" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/0.April/03-04-2024/4_kaler-kantho--3-2024.jpg" width="357" />মতো কম জীবনকালের ধানও চৈত্র মাসের মাঝামাঝি ঘরে তোলা সম্ভব হয় না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ফলে চৈতালি ঢলের ভয় না থাকলেও বৈশাখী ঢলের ভয় রয়ে যায়। হয়তো আগাম রোপণ করতে পারলে বৈশাখী ঢলের আগে ধান ঘরে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে জাতটি অবশ্যই ঠাণ্ডাসহিষ্ণু হতে হবে। কিন্তু চাষিদের পছন্দের জাত ব্রি ধান২৮ বা ব্রি ধান২৯ চারা থেকে থোড় পর্যন্ত কোনো অবস্থায়ই ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। তাই আগাম রোপণ করলেও তাদের ‘জীবনকাল’ বেড়ে যায়। ফলে সংবেদনশীল ‘কাইচ থোড়’ পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত শীতপীড়নের শিকার হয়ে ধান চিটায় পরিণত হয়। ১৪১৩ বঙ্গাব্দে (২০০৭ খ্রিস্টাব্দ) হাওরের চাষিদের একবার এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল। সে বছর বন্যার পানি এক মাস আগেই নেমে যায়। ফলে ‘জালা ফেলা’ থেকে শুরু করে জমিতে রোপণ—সবই এক মাস আগে আগে করতে হয়। ফলে শীতকাতর ধানের জাতগুলোর জীবনকাল বেড়ে যায় এবং চৈত্রের প্রথম দিকের রাতের আচমকা ‘প্রজনন-পর্যায়কালীন’ কয়েক দিনের ঠাণ্ডায় (এমন হতে পারে) সব ধান চিটা হয়ে যায়। অবশ্য সে বছর দিনের তাপমাত্রাও বেশ কমে গিয়েছিল। তবে চৈতালি ঢল আসেনি। এখন কথা উঠতে পারে, তাহলে চাষিরা আগাম বীজ ফেলে আগাম রোপণ করতে গেলেন কেন! সহজ উত্তর, হাওরে যতই পানি থাক না কেন, পানি ‘নামায়’ (হাওরের কেন্দ্রের দিকে) নেমে গেলে দূর থেকে টেনে এনে ধান জন্মানো সহজ কর্ম নয়। তাই চাষিরা ‘নামতে থাকা পানি’র যথাযথ ব্যবহার করতে চান।</p> <p style="text-align: justify;">হাওরের ধান চাষিদের সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যেই আধুনিক কৃষি গবেষণার শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা চিন্তা-ভাবনা করে আসছেন। এ জন্য ব্রিটিশ আমলে (১৩৪১ বঙ্গাব্দ) ইম্পেরিয়াল কাউন্সিল অব অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তৎকালীন আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার হবিগঞ্জে একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। তাদের চেষ্টা ছিল ‘ভালো ফলনশীল’ হাওরের উপযোগী স্বল্প জীবনকালীন ধানের জাত উদ্ভাবন করে ‘বৈশাখী ঢল’ থেকে ফসলকে রক্ষা করা। এ লক্ষ্যে তারা ১৩৫২ বঙ্গাব্দ (১৯৪৬) নাগাদ ১৫০ দিনের হবিগঞ্জ বোরো ৪ (বি১৬-৩ : খইয়া বোরো) উদ্ভাবন করে। জাতটি মন্দের ভালো ছিল। হাওরের নিচের দিকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রোপণ করা যেত। তবে বৈশাখী ঢল একটু আগাম নেমে এলে এই ধান ঘরে তোলা সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। যা হোক, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের যুগে আজকের বিজ্ঞানীরা হাওরের ঢল নিয়ে বেশি বেশি করে ভাবছেন। তাঁরা চারা অবস্থা থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত ‘শীতসহিষ্ণু’ জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। তাহলে চৈত্রের মাঝামাঝি ঘরে তোলা যাবে। তাই কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে ব্রি এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) হাওর নিয়ে যৌথভাবে কাজ করছে। তাদের উদ্ভাবিত বেশ কিছু কৌলিক সারি (BR11894-R-R-R-R-169, BR11894-R-R-R-R-329, TP16199) যথেষ্ট শীতসহিষ্ণু বলে প্রমাণিত হয়েছে। কার্তিকের প্রথম সপ্তাহে (অক্টোবরের ২৫) এগুলোর ৩০ থেকে ৩৫ দিনের চারা রোপণ করতে পারলে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি জাতগুলো কাটা যাবে। ফলে বৈশাখী ঢল যদি একটু আগামও আসে, তাহলেও সমূহ ক্ষতির হাত থেকে বোরো ধানকে বাঁচানো যাবে। কিন্তু আগাম চৈতালি ঢল থেকে বাঁচার কোনো উপায় দেখছি না। কারণ তখনো হাওরের ধান কাইচ থোড় থেকে ফুল ফোটার মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকে। এ সময়ের মধ্যে পাকা ধান ঘরে তুলতে হলে বোরো ধানের জীবনকাল ১৩০ দিনের মধ্যে হতে হবে। সে জন্য আরো অনেক গবেষণার দরকার আছে, যদিও অতীতে বিজ্ঞানীরা সে চেষ্টা করেছেন। তাঁরা আউশের কিছু ভালো জাত বোরোতে জন্মানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁদের ধারণা ছিল, আউশের একটি ১০০ দিনের জাত বোরোতে ১৩০ দিনের মধ্যে জন্মানো যাবে। ফলন কিছুটা বাড়বে এবং মৌসুমি ঢলের হাত থেকে ফসলও রক্ষা পাবে, কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেননি। কারণ প্রতিবেশের সঙ্গে আউশ ও বোরো ধানের অভিযোজন পদ্ধতির মধ্যে বেশ পার্থক্য বিদ্যমান।</p> <p style="text-align: justify;">চৈতালি ঢল নিয়ে কিছু বলি। বিজ্ঞানীদের মতে, চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ (মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম) থেকে পরবর্তী তিন-চার দিন হাওরে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যদি ১৫০ মিলিমিটার (সংকট মাত্রা) ছাড়িয়ে যায়, তবেই ওই এলাকায় এ ধরনের ঢল হওয়ার সম্ভাবনা। চৈতালি ঢল অতীতে ছিল। তবে আজকের মতো এতটা ভয়ানক আকারে ছিল বলে কোনো রেকর্ড নেই। বঙ্গাব্দ ১৩৫৩ (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ১৪২৩ (২০১৭ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত মোট ছয়বার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ১৩৭০ বঙ্গাব্দে প্রথম সংকট মাত্রা অতিক্রম করে। সেবারে ওই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৫৬ মিলিমিটার। সংকট মাত্রা থেকে সামান্য বেশি। তার পরে ১৩৮৮ বঙ্গাব্দে (১৮ বছর পর) সংঘটিত মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৯১ মিলিমিটার। এর ১৪ বছর পর (১৪০২ বঙ্গাব্দ) বৃষ্টিপাত সংকট মাত্রা কিছুটা অতিক্রম করে। এর পর থেকে চৈতালি ঢলের ‘প্রত্যাবর্তন-সময়’ কমে গিয়ে সাত বছরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। যেমন—১৪০৯ ও ১৪১৬ বঙ্গাব্দে এই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৬৬ ও ২৬৫ মিলিমিটার। সাধারণ বছরের তুলনায় যথাক্রমে ২.৬৩ ও ৪.২০ গুণ বেশি (সাধারণ বছরে ওই সময়ে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমবেশি ৬৩ মিলিমিটার)। কিন্তু ১৪২৩-এ গিয়ে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬২৫ মিলিমিটার। সাধারণ বছরের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। ফলে সুনামগঞ্জসহ পুরো হাওর এলাকা ডুবে যায়। শুধু ধানই নষ্ট হয়ে যায় এমন নয়, মাছসহ পুরো হাওরের জীববৈচিত্র্য দুমড়েমুচড়ে যায়।</p> <p style="text-align: justify;">বৈশাখী ঢলের চেয়ে চৈতালি ঢল নিয়ে আমার বেশি ভয়। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের মৌসুমি ঢলের ‘প্রত্যাবর্তন-সময়’ কমে আসছে এবং প্রখরতা বাড়ছে। ব্রির গবেষণা মোতাবেক এ সময় এখন মাত্র সাত বছর। ভবিষ্যতে ‘প্রত্যাবর্তন-সময়’ আরো কমতে পারে। গত ১৪২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্রে এমন ঘটনা আমরা দেখেছি। এখন ১৪৩০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস। অর্থাৎ আগাম ঢল (যদি আসে) আসার প্রকৃষ্ট সময় দোরগোড়ায়।</p> <p style="text-align: justify;">এ ধরনের ‘প্রলয়’ বাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই বলে হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। ক্ষতিটাকে (যদি এমন কিছু ঘটে যায়) সাময়িক ভেবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে হবে। কারণ এভাবেই প্রকৃতি মাঝেমধ্যে ধুয়েমুছে সাফ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ এবং সমৃদ্ধ করে নেয়। ফলে পরের বছর অতিরিক্ত উৎপাদন দিয়ে আগের বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব।</p> <p style="text-align: justify;"><b>লেখক : </b>সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন</p> </article>