<article> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। এই দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে আরো অনেকের সঙ্গে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর ও তাঁর সরকারের সমর্থন ও সহায়তা না পেলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কঠিন হয়ে যেত।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আরো অনেক বেশি রক্তপাত হতো। তাঁর সহায়তায় একাত্তরের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার, যা মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত। যুদ্ধকালীন এমন একটি সরকার গঠনের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। সেই সরকারের সব সদস্য ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তাঁরা একজন স্পিকারের কাছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শপথ নিয়েছেন। একজন সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়া হয়। তখনকার ভারত সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তা পাওয়া না গেলে এসব করা কঠিন হতো।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="ইন্দিরা গান্ধী " height="270" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/31-03-2024/mk/kk-4-2024-03-31-01a.jpg" width="321" />১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করছিলেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অন্য সবার মতো তিনিও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর কামনা করেছিলেন। তবে তিনিও হয়তো অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আঁচ করতে পেরেছিলেন যে সবাই যেমনটি কামনা করছেন, তেমনটি না-ও হতে পারে। শুরু থেকে পাকিস্তানের কোনো কাজই ঠিকভাবে শেষ হয় না। তিনি এই ভেবে খুব সচেতন ছিলেন যে প্রতিবেশীদের মধ্যে যেকোনো রকমের অশান্তি তাঁর দেশে প্রভাব ফেলবে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ষড়যন্ত্রের কাছে আবারও গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ল।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানের সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান শুরু করল তাদের চিরাচরিত প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। নেমে এলো ২৫ মার্চের কালরাত। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আবারও প্রমাণ করল গণতন্ত্র বা জনগণের ম্যান্ডেটে নয়, তারা বিশ্বাস করে বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের যে বাঙালি নিধন বা গণহত্যা শুরু করেছিল, তা বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরু করার পরই বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতা চেষ্টা করলেন সীমান্তের ওপারে গিয়ে ভারতের কাছ থেকে সহায়তা নিতে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছের সবাইকে আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। বলে রেখেছিলেন দেশে এ ধরনের দুর্যোগ নেমে এলে ওপারে গিয়ে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এমনই একজন নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। পরিস্থিতি মূল্যায়নে তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভার মানুষ। বুঝতে পারতেন আসন্ন রাজনৈতিক সংকটের কথা। সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন দ্রুত। তাজউদ্দীন তরুণ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩০ মার্চ ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করেন। তিনিসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জানতেন যে বাংলাদেশের  ভবিষ্যৎ অনেকাংশে অনিশ্চিত এবং সম্ভাব্য বড় ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হলে তাঁদের অবশ্যই ভারতের কাছ থেকে নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন পেতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">সীমান্ত পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন বিএসএফের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলোক মজুমদার। বিএসএফের সহায়তায় তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ১ এপ্রিল দিল্লিতে পৌঁছতে সক্ষম হন। দিল্লি পৌঁছে তাঁরা অবাক হয়ে দেখেন, এরই মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন দেশের সেরা দুজন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও অধ্যাপক আনিসুর রহমান। এই দুজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত, যাঁরা সর্বদা বঙ্গবন্ধুকে এমন সব অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করতেন, যা পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের ভিত রচনায় সহায়তা করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচির অর্থনৈতিক দিকগুলো সমৃদ্ধ করেছিল। দিল্লিতে এই দুই অর্থনীতিবিদ কার্যত অন্য একজন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের (পরে নোবেল বিজয়ী) অতিথি ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে বৈঠকের আয়োজনে এই তিন অর্থনীতিবিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিচক্ষণ তাজউদ্দীন আহমদ এরই মধ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমর্থন ও সমন্বয়ে একটি বৈধ সরকার গঠনের পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন।</p> <p style="text-align: justify;">সাক্ষাৎকালে ইন্দিরা গান্ধীকে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা ও আশু পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন, যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি টার্নিং পয়েন্ট। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাটি বিশ্বের বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর আগে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে একটি বৈধ নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন জনগণের কণ্ঠস্বর। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা বাঙালিকে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবুজ সংকেত দেন এবং বলেন, প্রয়োজনে তাঁরা ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারেন।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ভারতে উপস্থিত সব এমএনএ এবং এমপিএর সমর্থনে বাংলাদেশের প্রথম সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত, তা গঠিত হয়েছিল তিস্তার উজানে শিলিশুড়ি নামক স্থানে। বস্তুতপক্ষে সেটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম সংসদ অধিবেশন। সরকারে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। সিদ্ধান্ত হয় রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে তিনিই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন মোট ছয়জন। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে বাংলাদেশের ছয় সদস্যের এই মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। পঠিত হয় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম রচিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। খালেদা জিয়ার শাসনামলে এই ঘোষণাপত্র সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল বিশ্বমুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। এই সরকার ছিল একটি বৈধ সরকার, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম-অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারে।</p> <p style="text-align: justify;">এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের এই কঠিন সময়ে বিশ্বসম্প্রদায় ছিল অন্যদিকে তাকিয়ে। আগস্ট মাস নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে আসা এক কোটিরও বেশি উদ্বাস্তু আশ্রয় নেয়। ভারতের এসব রাজ্যের সাধারণ মানুষের ত্যাগও কম ছিল না। মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালের ভারত আর বর্তমান ভারত এক নয়। ভারতের নিজস্ব অনেক অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল। দেশটি তখনো একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত।</p> <p style="text-align: justify;">ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে এসেছিলেন, তাদের দুর্দশার কথা শুনেছিলেন এবং তাদের অবস্থানকে নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক করতে সব কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের এই কঠিন সময়ে একমাত্র দেশ, যেটি কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেটি ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন।</p> <p style="text-align: justify;">ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ট্র্যাজেডিকে আন্তর্জাতিকীকরণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি তাঁর দেশের পূর্ব সীমান্তে যে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় চলছে এবং তাঁর দেশের নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি হতে পারে, সে সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের অবহিত করার জন্য ১৯ দিনের সফরে বের হন। এই ১৯ দিনের সফরে তিনি ইউরোপের প্রায় এক ডজন রাজধানী সফর করেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন। কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে। সবাই তাঁর বক্তব্য শুনলেও কার্যত কোনো সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেননি। ইন্দিরা গান্ধী ৪ ও ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে দেখা করেন। হোয়াইট হাউসে তাঁর সফরের সময় নিক্সনের পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জার এই বৈঠকে না থাকার সিদ্ধান্ত নেন। নিক্সন হোয়াইট হাউসের অতিথিকক্ষে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রায় ২০ মিনিট বসিয়ে রাখেন, যা ছিল তাঁর প্রতি চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ।</p> <p style="text-align: justify;">অনেকটা হতাশ হয়ে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে ফিরে আসেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশের সংকট তাঁকে একাই সামলাতে হবে। একমাত্র সমাধান হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখা। তত দিনে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। ৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন কলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে বিনা উসকানিতে আক্রমণ চালায়। মঞ্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে খবরটি দিলে তিনি তাঁর বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা ছাড়েন। কোনো সময়ক্ষেপণ না করে সে রাতেই তিনি ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষের সভা আহবান করেন এবং সদস্যদের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং ঘোষণা করেন যে এখন থেকে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করছে। তিন দিন পর বিশ্ব শুনতে পেল স্বাধীন বাংলাদেশ ও তার সরকারকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। ১৯৭১-এর রক্তাক্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর, যখন পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। রাতে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের পার্লামেন্টে এক আনন্দঘন পরিবেশে ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী।’ পার্লামেন্টের ভেতরে সদস্যরা উচ্চৈঃস্বরে স্লোগান দেন ‘জয় বাংলা’। এই মার্চ মাসে প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।</p> <p style="text-align: justify;"><b> লেখক : বিশ্লেষক</b> ও গবেষক</p> </article>