<article> <p style="text-align: justify;"><strong>স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাকিস্তানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আইনগত দলিল। সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশ সৃষ্টির ঘোষণাকে মেনে না নেওয়া</strong></p> <p style="text-align: justify;">মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দল যেসব ভয়ংকর ও ডাহা মিথ্যাচার করে, তার মধ্যে একটি হলো স্বাধীনতার ঘোষণা। ২০০১-এর পর তাদের মিথ্যাচারে নতুন সংযোজিত হলো জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এটি কেবল একটি পরিকল্পিত মিথ্যাচারই নয়, জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করা বাংলাদেশের প্রতি অনাস্থা ও রাষ্ট্রদ্রোহ। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তারের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও তাঁকে গ্রেপ্তারের সংবাদ ওই সময়ের অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মধ্যে অন্যতম হলো বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান, ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস হেরাল্ড, ব্যাংকক পোস্ট, বার্তা সংস্থা এপি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ ছাড়া ভারত, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের বহু সংবাদপত্রের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা" height="303" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/26-03-2024/3.jpg" width="500" />উদাহরণস্বরূপ সে সময়ের দু-একটি সংবাদ শিরোনাম উল্লেখ করছি।  নিউ ইয়র্ক টাইমসে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপিয়ে পাশেই লেখা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক’, ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে’, ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, ‘...ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।’ </p> <p style="text-align: justify;">১৯৭১-এর ২৬ মার্চ কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশনস গ্রুপ’-এর একটি সভা ডাকেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, সিআইএ, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন। সিআইএর পরিচালক রিচার্ড হেলমস পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কনসুলেট সূত্রে সভায় এই মর্মে অবহিত করেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র সময় ২৫ মার্চ দুপুর ১টায় মুজিবুর রহমানকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করার সময় তাঁর দুজন সমর্থক নিহত হন। গ্রেপ্তারের আগে মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে একটি গোপন রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">১৯৭১-এর ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সময় সকাল সাড়ে ৭ ঘটিকার এবিসি টেলিভিশনের সংবাদে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা প্রচার করা হয়  (https://youtu.be/TD5EfjA7YC0?si=LE1dkfArdtYmqGG3)| ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে এবং মুজিবকে পুরোপুরি দোষারোপ করে বলেছিলেন, ‘Sheikh Mujib has declared independence of East Pakistan. He is a traitor. This time he will not go unpunished.’ সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমান এলডিপির প্রধান কর্নেল অলি আহমদ (অব.) তাঁর রচিত ‘Revolution, Military Personnel and The War of Liberation in Bangladesh’ গ্রন্থে তাঁর চাকরিকালীন বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন সংযোজন করেছেন। গোপনীয় প্রতিবেদনটি লিখেছেন প্রয়াত বিএনপি নেতা মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী। তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার মীর শওকত আলী অলি আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘He in fact was the first officer who took risk and on his own initiatives informed Gen. Ziaur Rahman regarding Declaration of Independence on night 25/26 March 71.’ যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বস্তুত তিনিই (কর্নেল অলি) প্রথম কর্মকর্তা, যিনি ঝুঁকি নিয়ে নিজ উদ্যোগে একাত্তরের ২৫/২৬ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অবহিত করেন।’ মীর শওকতের এই প্রতিবেদনটি পরবর্তী সিনিয়র অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান নিজেই সত্যায়িত করেছেন। ২০০৯ সালের ২১ জুন আমাদের উচ্চ আদালত মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ সালামের করা এক জনস্বার্থে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক—মর্মে রায় প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই একাধিক বক্তৃতায়, ১৯৭২ সালে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের বক্তৃতায় ও ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে চট্টগ্রামে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার স্মৃতিচারণা করেছেন। সর্বোপরি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত বাংলাদেশের জন্ম সনদ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ রয়েছে। এটি বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন প্রথম সংবিধান। এই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার বৈধতা অর্জন করে এবং এরই ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি অনুমোদন করেছেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান ও সে ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদনের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ঘোষণায় উল্লেখ রয়েছে, ‘...বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’ ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি...; আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাকিস্তানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আইনগত দলিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার করা মানে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের প্রতি অনাস্থা, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বাংলাদেশ সৃষ্টির ঘোষণাকে মেনে না নেওয়া। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্যদিকে সংবিধানের ৭ক। (১)(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ আর ৭ক।(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p style="text-align: justify;">zhossain1965@gmail.com</p> </article>