<article> <article> <p style="text-align: justify;">পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৭১ সালে এ দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা নৃশংসতম। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা রকম শোষণের মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পূর্ব বাংলার মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুললে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের (self determination) সংগ্রামের সূচনা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর রেসকোর্স ময়দানে সমবেত জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য ডাক দেন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালি নিধনের নৃশংস অভিযান শুরু করে। এই গণহত্যা দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলতে থাকে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আমাদের বিজয় অর্জিত হয় এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল এবং দুই লাখের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছিল। হত্যাকারী পাকিস্তানিদের প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">প্রাণের ভয়ে ১৯৭১ সালে এক কোটির বেশি মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকার, আলবদরদের সহযোগিতায় বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষক, চিকিৎসকসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আন্তর্জাতিকভাবে ১৯৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। </p> <p style="text-align: justify;">অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মতো কানাডা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হলোকাস্ট, রুয়ান্ডান গণহত্যা ও সাম্প্রতিক মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত গণহত্যাসহ আটটি গণহত্যাকে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়নি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তবে দেশটির সরকার ও জনগণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাই হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে কানাডায় ১৯৭১-এর গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরে স্বীকৃতি আদায় করতে কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করি। এরই মধ্যে সরকার ২০২০ সালের মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তথা মুজিববর্ষ উদযাপনের ঘোষণা দেয়। এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে এবং দেশটিতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও অবদান এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রচার ও গবেষণার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীরতর করতে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার তাগিদ অনুভব করি। কিছু দেশপ্রেমিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশি-কানাডিয়ানদের সহযোগিতায় ও আমার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ম্যানিটোবা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী উইনিপেগে সরকারের কোনো প্রকার আর্থিক সংশ্লেষ ব্যতিরেকে অনুদাননির্ভর Bangabandhu Center for Bangladesh Studies in Canada (BCBS) প্রতিষ্ঠিত হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অধিকন্তু কানাডা সরকার কর্তৃক ২৮ বছর ধরে আশ্রিত জাতির পিতার অন্যতম প্রধান হত্যাকারী খুনি নূর চৌধুরীকে Deportation-এর মাধ্যমে দেশে  ফিরিয়ে নিয়ে বিচারের রায় কার্যকর করতে কানাডায় ব্যাপক জনমত গঠনের ভাবনাও বিসিবিএস প্রতিষ্ঠায় আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। </p> <p style="text-align: justify;">বিসিবিএস বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়টি কানাডাব্যাপী প্রচারের উদ্যোগ নেয়। এসব সেমিনারে দেশি-বিদেশি গণহত্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা হয়। সেমিনারের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই অবগত নয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃতির পেছনে বৈশ্বিক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বিবেচনা করা হয়। এসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হলে একাডেমিয়াসহ আন্তর্জাতিকভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সঠিকভাবে গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরা জরুরি। আমরা চিহ্নিত করলাম যে  কানাডার উইনিপেগে অবস্থিত দেশটির ক্রাউন করপোরেশনের অধীন কানাডিয়ান মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটস (CMHR) এরই মধ্যে হলোকাস্ট ও রোহিঙ্গা গণহত্যাসহ অন্যান্য গণহত্যার প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিয়েছে। তাই আমরা এই জাদুঘরের কিউরেটর ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. জেরেমি মেলভিন মেরনকে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরি। কয়েক দফা আলাপ-আলোচনার পর ঢাকাস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় বিসিবিএস কানাডিয়ান মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটসে ১৯৭১-এর গণহত্যার স্থায়ী প্রদর্শনের জন্য আবেদন করে। এরপর শুরু হয় আমাদের আবেদনের পেছনে প্রমাণাদি উপস্থাপনের কাজ। এ লক্ষ্যে একাত্তরের গণহত্যার নিদর্শন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গণহত্যা বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম মুলার এবং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে CMHR-এর কিউরেটর ড. জেরেমি মেলভিন মেরনের ঢাকা সফর আয়োজন করা হয়। তাঁরা ১৯৭১ সালে রাজধানী ঢাকা ও সংলগ্ন অন্য যেসব এলাকায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেসব স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং একাত্তরে শহীদ ব্যক্তিদের পরিবার এবং নির্যাতিতদের সঙ্গে দেখা করেন। এ ছাড়া এই বিশেষজ্ঞরা সেই সময়কার বিভিন্ন নথিপত্র ও ডকুমেন্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের উপস্থাপনা তথ্যনির্ভর কি না, তা খতিয়ে দেখেন। তাঁরা কানাডায় ফেরত এসে দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র ও শিক্ষকসহ  বাংলাদেশি-কানাডিয়ানদের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিক কমিউনিটি মতবিনিময়সভা করে। দুটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">মিউজিয়ামে ১৯৭১ সালের গণহত্যার প্রদর্শনের বিষয়টি রাজি করানো সহজ ছিল না। কানাডায় থাকা একটি দূতাবাস থেকে CMHR কর্তৃপক্ষকে জানায়, একাত্তরে কোনো গণহত্যা সংঘটিত হয়নি এবং গণহত্যার স্থায়ী  প্রদর্শন না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এমনকি একটি বিশেষ দেশ থেকে আগত ইমিগ্র্যান্টরা স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে কানাডার সংসদে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারমূলক পিটিশন করে। এসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে অবশেষে সম্প্রতি CMHR তাদের Breaking the Silence Gallary-তে একাত্তরের গণহত্যা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতির স্থায়ী প্রদর্শন করতে সম্মত হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ২০২৪-এ স্থায়ী প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে বলে আমরা আশা করছি। এই সিদ্ধান্ত কানাডাসহ বিশ্বব্যাপী ১৯৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতির প্রচেষ্টায় একটি বড় মাইলফলক। এর মাধ্যমে কানাডাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে ১৯৭১-এর গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পথ সহজতর হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভবিষ্যতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে এমন নির্মম গণহত্যার পুনরাবৃত্তি রোধে বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি করবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার যথাযথ স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের এই জঘন্যতম অপরাধকে ইতিহাস দায়মুক্তি দেয় না ও ক্ষমা করে না।</p> <p style="text-align: justify;"><b>লেখক : কানাডায়</b> বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও কানাডা বঙ্গবন্ধু সেন্টারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক</p> <p style="text-align: justify;">krahman@mofa.gov.bd</p> </article> </article>