<article> <p>বঙ্গবন্ধু সম্ভবত জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ মুক্তিকামী বাঙালির সামনে। আজ পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর কাতারে ঠাঁই করে নিয়েছে এ অনন্য ভাষণ। ইউনেসকো স্বীকৃতি দিয়েছে এই ভাষণকে বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে। ৭ মার্চের ভাষণ যতবার শুনি, কখনো পুরনো বা বহুশ্রুত মনে হয় না।</p> </article> <p>এই ভাষণের ভিডিওচিত্র দেখে শিহরণ বোধ করি। মনে হয় নতুন করে শুনছি। ভালো লাগা গান বা কবিতা যেমন আমরা বারবার শুনি, এটিও তেমনি একটি রাজনৈতিক কবিতা, যা বারবার শুনতে ইচ্ছা করে। আর একটি বিষয় লক্ষ করে আনন্দিত হই যে দেশপ্রেমিক সব বাঙালিই তাঁর ভাষণের চুম্বক কথাগুলো অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে।</p> <article> <p>বিস্ময়ে আমাদের হতবাক হতে হয় যে সেদিন বঙ্গবন্ধু কী করে এই অসাধারণ ভাষণটি দিয়েছিলেন। সামনে কোনো নোট নেই, স্মৃতি থেকে অনর্গল বলে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস। বলছেন চলমান আন্দোলনের পরিস্থিতি সম্পর্কে। পুনর্ব্যক্ত করছেন বাঙালির দাবিগুলো।</p> </article> <article>সতর্ক করে দিচ্ছেন ক্ষমতাসীনদের বাঙালির ওপর অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’ সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিচ্ছেন সামনের দিনগুলোতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে। আমাদের বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না যখন দেখি কী নেই এই ভাষণে! <p>আমরা সবাই জানি, সেদিন বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রবল চাপ ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার। বিশেষ করে চলমান আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি ছাত্র নেতৃবৃন্দ বারবার তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, স্বাধীনতা ঘোষণার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন তিনি কী করবেন। সেদিন যদি তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তবে রেসকোর্স ময়দানে আরেকটি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড আমরা প্রত্যক্ষ করতাম। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তৈরি হয়েই ছিল।</p> <p>সবচেয়ে বড় কথা, ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ নিতে হতো। পরবর্তীকালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছিল, তা আমরা পেতাম না। বঙ্গবন্ধু সেটা জানতেন বলেই সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। কিন্তু জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা ভেবে তিনি ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ‘মুক্তি’র সঙ্গে মিলিয়ে এমনভাবে দুবার উচ্চারণ করলেন যে স্বাধীনতার কথা বলা হলো ঠিকই; কিন্তু কেউ তাঁকে অভিযুক্ত করতে পারলেন না যে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বিচক্ষণতা ও বাগ্মিতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন।</p> </article> <article> <p>১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলন ছিল অভূতপূর্ব এক আন্দোলন। বাঙালির এমন ঐক্য আগে কখনো এ ভূখণ্ডে দেখা যায়নি, আর ভবিষ্যতেও আমরা দেখতে পাব বলে মনে করি না। আজকের বাংলাদেশে তখন সব কিছু চলেছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পাকিস্তানি শাসনের উপস্থিতি ছিল কেবল সেনা ছাউনিতে। অন্য সব সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি অফিস-আদালত চলেছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তিনিই সেদিন ছিলেন বাংলাদেশের শাসনকর্তা। তার যুক্তিও ছিল। নির্বাচনে জনগণ তাঁকে ও তাঁর দলকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদান করেছিল।</p> <p>বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে থেকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। ছয় দফা থেকে স্বাধিকার আন্দোলন এবং চূড়ান্ত পর্বে স্বাধীনতাসংগ্রাম। তিনি কোনো অন্যায় পদক্ষেপ নেননি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে, তখনই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৭ মার্চে তিনি কেবল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং জাতিকে প্রস্তুত হতে বলেছিলেন।</p> <p><img alt="যেখানে বারবার ফিরে আসতে হবে" height="320" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/07-03-2024/0.jpg" style="float:left" width="355" />এমন নয় যে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের প্রস্তুতির কথা তিনি জানতেন না। সর্বশেষ সব সংবাদই তাঁর কাছে আসত। তবু তিনি আলোচনার দ্বার বন্ধ করেননি। চেয়েছিলেন আন্দোলনরত মানুষকে হত্যা করা বন্ধ হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। তিনি এটাও জানতেন যে তাঁর ওপর আক্রমণ আসবে, হয়তো তাঁকে হত্যা করা হবে। ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা ছিলেন বলেই সেদিন তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে; এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু—আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’</p> <p>বঙ্গবন্ধু চিরদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছেন, আন্দোলনের সময়েও সে কথা বলতে ভোলেননি। মানুষের কষ্ট, বিশেষ করে গরিবের কষ্ট লাঘবে তিনি আজীবন কাজ করেছেন। আন্দোলনের সময় যাতে গরিব মানুষের কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখতে তিনি সবাইকে অনুরোধ করেছেন। এমন মানবিক গুণাবলি কজন নেতার থাকে? সে জন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু।</p> <p>গরিব মানুষের জন্য কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মমতা। সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর পরিবারের ঔদার্যে।</p> <p>আমরা গর্বিত যে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীও পিতার অনেক গুণের মতো গরিব-দুঃখী মানুষকে ভালোবাসার গুণটি লাভ করেছেন। তাই আমরা দেখি সরকারি পর্যায়ে দরিদ্র মানুষের কল্যাণে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বেসরকারিভাবেও তিনি সব সময় গরিব-দুঃখী মানুষকে সহায়তা করে থাকেন।</p> <p>আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের পাঁচটি অক্ষয় প্রতীক—আমাদের জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় সংগীত আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। কালজয়ী এ ভাষণের কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হবে। এ ভাষণ আমাদের সাহস জোগাবে, পথের দিশা দেবে। তরুণ প্রজন্ম এ ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হবে, গৌরব বোধ করবে যে এমন নেতার উত্তরাধিকার আমরা বহন করছি।</p> <p>জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।</p> <p><b>লেখক : </b><strong>সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব</strong></p> </article>