<article> <article> <p>প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত তিন দিনের নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দেন। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটিই তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। সফরকালে তিনি সম্মেলনের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনটি তার ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর বিশ্বনেতাদের খোলাখুলি আলাপ-আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করায় এবারের সম্মেলনটি বিশেষ গুরুত্ব পায়।</p> <p>১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সম্মেলনের ‘ফ্রম পকেট টু প্লানেট : স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে শেখ হাসিনা ছয়টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। ওই প্রস্তাবগুলোতে তিনি যেমন যুদ্ধ-সংঘাত বন্ধ এবং নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে নির্মমভাবে হত্যা না করার কথা বলেছেন, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে রক্ষা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের কথাও বলেছেন। তবে তাঁর উপস্থাপিত ছয়টি প্রস্তাবের মধ্যে পাঁচটিই জলবায়ুসংক্রান্ত সমস্যার উত্তরণে করণীয় পদক্ষেপ নিয়ে।</p> </article> <article> <p><img alt="মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে শেখ হাসিনা" height="279" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/February/22-02-2024/mk/kk-6-2024-02-22-01a.jpg" style="float:left" width="300" />শেখ হাসিনার উপস্থাপিত জলবায়ুসংক্রান্ত পাঁচটি প্রস্তাবে ছিল—১. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা; ২. জলবায়ুর প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য অভিযোজন অর্থায়নের বর্তমান পর্যায় অন্তত দ্বিগুণ করা; ৩. বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থপ্রাপ্তি সুগম করার জন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করা; ৪. জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঋণের বোঝা দূর করতে তাদের জন্য অনুদান ও সুবিধাজনক ঋণ লাভের সুযোগ বাড়ানো এবং ৫. জলবায়ু কর্মসূচির বাস্তবায়নে বেসরকারি পুঁজিপ্রবাহের জন্য সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা।</p> </article> <p>পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব প্রকল্পের জন্য বেসরকারি পুঁজি আকর্ষণ করার জন্য উদ্ভাবনী ও মিশ্র অর্থায়নের ব্যবস্থা গড়ে তোলা।অন্যদিকে অস্ত্র প্রতিযোগিতাসংক্রান্ত প্রস্তাবটিতে তিনি বলেন, বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারি এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে, যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। শেখ হাসিনা অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে সেই অর্থ জলবায়ু তহবিলে দেওয়ার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহবান জানান। এ ছাড়া তিনি তাঁর বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপের বর্ণনা দেন এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যে ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে সেসবেরও উল্লেখ করেন।</p> <p>সম্মেলনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের বাইরে শেখ হাসিনা জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিস মেটে ফ্রেডরিকসেন, কাতারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল রহমান আল-থানি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি এবং নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। ওই সব বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি ছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর, মেটা গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট নিক ক্লেগ, বিশ্বব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট পলিসি অ্যান্ড পার্টনারশিপের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যামেরন, উইমেন পলিটিক্যাল লিডারসের (ডাব্লিউপিএল) সভাপতি সিলভানা কোচ-মেহরিন এবং জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী মিস শুলজ।         </p> <article> <p>তিন দিনের এই সম্মেলন ছিল বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আয়োজন, যেখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকরা অংশ নিয়েছিলেন। জলবায়ু নিরাপত্তার ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা হলেও চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত এবং ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা শঙ্কা নিয়েই আলোচনা প্রাধান্য পায়। তা ছাড়া রাশিয়ার কারাবন্দি বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সাই নাভালনির আকস্মিক মৃত্যু নিয়েও বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার আগ্রহ দেখা যায়।</p> <p>সম্মেলনে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে কাজ করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর এবং খোদ ইউক্রেনের সক্রিয়তা। পুরো সম্মেলনজুড়েই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং তাঁর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বৈঠকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখ করে যুদ্ধ বন্ধের আহবান জানান। তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেন, উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার কথাও বলেন।</p> </article> <article> <p>সম্মেলনে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার প্রশ্নটিও উঠে আসে। ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতা যে সুষ্ঠু সমাধান দিতে সক্ষম নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারকে বাস্তবায়ন করা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না—সে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি নিধন বন্ধের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।     </p> <p>টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর এটিই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রথম বিদেশ সফর ছিল। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সব ফোরামেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে শেখ হাসিনা সেসব ফোরামে বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। সংগত কারণেই এই সম্মেলনে তিনি ওই দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য আরো তহবিলের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত প্রস্তাবগুলো এ বছরের নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠেয় ‘কপ-২৯’-এর কার্যপ্রণালী প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।</p> <p>তা ছাড়া সম্মেলনকালে অনেক দেশের ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদলের সঙ্গেও শেখ হাসিনার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, মতবিনিময় হয়েছে; সেসব দেশের বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী ও বহুমুখী সম্প্রসারণের বিষয়গুলোতে অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের গত নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের যে নেতিবাচক মনোভাব ছিল তা পরিবর্তনের সুযোগ ঘটেছে। তাই তো সব দেশ ও প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর সেই সাফল্যটি এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিউনিখ সম্মেলনে যোগদানের ফলেই।</p> <p><strong>লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব </strong>  </p> </article> </article> <p> </p>