<article> <p style="text-align: justify;"><strong>বাংলা ভাষায় বিবিধ রকমের কথা বলা হয়। এ রকম একটি সমৃদ্ধ ভাষায় যারা কথা বলে, তারা হাজার বছরের সংস্কৃতিরও উত্তরাধিকারী। ভাষার পথ ধরেই সংস্কৃতির কাছে পৌঁছে যাই আমরা</strong></p> <p style="text-align: justify;">স্বাধীনতার পর সর্বস্তরে বাংলা চালু করার একটা জোয়ার আসে। এমন অবস্থা যে অন্য কোনো ভাষা জানার প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে যায়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সেই সময়ে বিশেষ করে ইংরেজির গুরুত্ব হঠাৎ কমে যায়, কিন্তু কোর্ট-কাছারি, বিদেশে যোগাযোগের কারণে ইংরেজির প্রয়োজনটা থেকেই যায়। এ সময় স্কুল-কলেজে ইংরেজি শিক্ষকের প্রবল অভাব দেখা দেয়। অভাবটা একটু তীব্র হতেই এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিতেই ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়ার হিড়িক শুরু হয়ে যায়। ইংরেজিতে ভালো ছেলেমেয়েরা সর্বত্রই উচ্চতর চাকরিবাকরির সুযোগ পেতে থাকে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এরপর শুরু হয় বিদেশে লেখাপড়ার ঝোঁক। উচ্চবিত্তরা তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও ছেলেমেয়েদের ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রে না হলেও নিদেনপক্ষে ভারতের নামিদামি স্কুল-কলেজে ভর্তি করার জন্য হন্যে হয়ে ওঠে। কালক্রমে ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে তার সংস্কৃতিটাও যুক্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তানের ২৪ বছর বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে একটা মিশ্র কারিকুলাম জারি ছিল, যদিও উচ্চ মাধ্যমিক থেকে এমএ পর্যন্ত ইংরেজি ছিল মুখ্য।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বিষয় হিসেবে বাংলা ও ইংরেজি দুই-ই পড়তে হতো গুরুত্বের সঙ্গেই। মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ইংরেজি ছিল একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম। স্বাধীনতার পর এমন বিষয়গুলোও বাংলায় রূপান্তরের চেষ্টা চলছিল, কিন্তু এক জায়গায় এসে সেসব থেমে যায়। এরপর শুরু হয় শিক্ষা কমিশনের হিড়িক এবং নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শিশুদের ওপর সব ধরনের পাঠের নির্যাতন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এই নির্যাতন থেকে শিশুদের বাঁচানোর জন্য হাইকোর্ট থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয় এই মর্মে যে শিশুর জন্য সহনশীল ওজনের মধ্যে বই-পুস্তক রাখতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="ভাষা ও সংস্কৃতি" height="362" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/February/21-02-2024/3.jpg" width="500" />এসব করতে গিয়ে শিক্ষা থেকে আনন্দ চলে যায়। কিন্তু নতুন এক উপাদান এসে যুক্ত হয়, যার নাম কোচিং। এই কোচিং অবশ্য নতুন নয়। একসময় পরীক্ষার আগে শিক্ষকরা দুর্বল ছাত্রদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করতেন। ম্যাট্রিক বা এসএসসি পরীক্ষার আগে শিক্ষকরা সামান্য কিছু সম্মানীর বিনিময়ে ভালো ফল যাতে হয় তার জন্য সানন্দেই সন্ধ্যার পর, ছুটির দিন সকালে স্কুলের ক্লাস টেনকে জাগিয়ে তুলতেন। কিন্তু কোচিং এখন সমান্তরালে চলে। এখন একটা স্কুল থেকে আরেকটা স্কুলে যাওয়া। স্যারের কাছে ৫০ থেকে ১০০ জন ছাত্র সকাল বা বিকেল বেলায় পড়তে যায়। আবার স্কুলেও যেতে হয়। উচ্চতর ক্লাসগুলোতে আর থাকে বিষয়ভিত্তিক কোচিং। একজন ছাত্রকে সাত-আটটি টিউটরের কাছেও যেতে দেখা যায়। এই কঠিন পাঠাভ্যাসের মধ্যে ভাষার ভাবনা বা ভাষা চিন্তাটাই হারিয়ে যায়।</p> <p style="text-align: justify;">একসময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে আমরা উচ্চারণ ঠিক করতাম। আজকাল ছেলেমেয়েদের মধ্যে সে রকম সুযোগ আর নেই। অহরহ ভুল বানান বা ভুল উচ্চারণ শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইংরেজিতে ভুল লিখলে সবাই রে রে করে খেপে ওঠে, কিন্তু বাংলায় ভুল লিখলে কেউ কিছু বলে না। ভাষা আন্দোলন মূলত ছিল মাতৃভাষাকে রক্ষা করা, তারপর এর মধ্যেই ঢুকে গিয়েছিল ভাষাকে কতটা সৃজনশীল করা যায় বা কতটা সৃজনশীল কাজে তা ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু উল্টোটাই হয়ে গেল। ভাষা অবহেলার শিকার হতে থাকে। ইংরেজি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের অভিবাসনমুখী করে তোলে। মাতৃভাষার শিকড়টা ছিঁড়ে ফেলে। মাথাটাও বিগড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাই অভিবাসন একবার হয়ে গেলে সেই বঙ্গসন্তান আর দেশে ফেরার কথা ভাবতে পারে না। এভাবেই মেধার অপচয় হতে হতে দেশটা কখনো যে মেধাশূন্য হয়ে পড়তে পারে তার আলামত নানা দিক থেকেই দেখা যাচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলা ভাষায় বিবিধ রকমের কথা বলা হয়। এ রকম একটি সমৃদ্ধ ভাষায় যারা কথা বলে, তারা হাজার বছরের সংস্কৃতিরও উত্তরাধিকারী। ভাষার পথ ধরেই সংস্কৃতির কাছে পৌঁছে যাই আমরা। যেহেতু শিক্ষাব্যবস্থাটাই ঠিক নেই, ভাষার প্রতি ভালোবাসার বোধ সৃষ্টি হয় না, তাই পরিবারগুলোতে সংস্কৃতিচর্চার কোনো ক্ষেত্র নেই। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উদ্বিগ্ন সাংবাদিকরা মিডিয়ায় বিকৃত বাংলা পরিবেশনের বিষয়টি উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু এসব নিয়ে বিস্তর কথা বলা হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">বিষয়টি এমন জায়গায় গেছে যে মাননীয় হাইকোর্টের বিচারপতিরা এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। ভাষাকে বিকৃত করলে তার জন্য আইনি ব্যবস্থার কথাও বলেছেন। কিন্তু সমস্যা গোড়াতেই, তা হলো শিক্ষা। নাটক, চলচ্চিত্র, থিয়েটার—এসবের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের বেশির ভাগই মনে করে, এসবের সঙ্গে লেখাপড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই মিডিয়ার সঙ্গে সাহিত্যের এবং অন্য শিল্পের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এসব না জেনেই অনেকের কিছু একটা হয়ে যাচ্ছে বলে তারা পরোয়া করে না। অনেক টিভি নাট্যকারের পাণ্ডুলিপি দেখে মনেই হয়, তাঁরা শুদ্ধ বা প্রমিত বাংলা জানেন না বলেই ‘আধুনিক’ ভাষায় লেখেন। তা-ও কোনো অঞ্চলের ভাষা নয়। তাঁদের সংখ্যাও কম নয়। পরিচালক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীও সদম্ভে আত্মপ্রসাদে তৃপ্ত হন। কারণ মুক্ত মিডিয়ার কালে সগৌরবে তাঁরা রুচির দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।</p> <p style="text-align: justify;">ভাষার প্রতি যদি ন্যূনতম আনুগত্য থাকত, তাহলে এগুলো ঘটত না। বিষয়টি গোড়া থেকেই ভাবতে হবে, ঠিক করতে হবে। সে জন্য ভালো শিক্ষক চাই, শিক্ষার্থী চাই এবং মিডিয়ার লোকদের সচেতন হতে হবে। আইনি ব্যবস্থা বা সরকারি সার্কুলার দিয়ে তা ঠিক হওয়ার নয়।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব</p> </article>