<article> <p style="text-align: justify;">বাংলায় কিছু প্রবাদ-প্রবচন চালু আছে। হরহামেশা ব্যবহার করা যায়—এমন একটি বহুল প্রচলিত প্রবচন হচ্ছে, যত দোষ নন্দ ঘোষ। কে এই নন্দ ঘোষ, কী তার দোষ—এ নিয়ে অনেক গল্পও চালু আছে। আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় তুলে ধরেছেন কেষ্ট নামের এক চরিত্র—‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর!’ আমাদের দেশের রাজনীতিতেও একটা অদ্ভুত প্রবণতা সব সময় লক্ষ করা যায়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কী সেই প্রবণতা? এ দেশের যা কিছু মন্দ, তার জন্য কে দায়ী? রাজনীতির মাঠের আর সবাই আঙুল তোলে আওয়ামী লীগের দিকে। দলটি যেহেতু ক্ষমতায়, এখন আঙুল তোলা হচ্ছে সরকারের দিকে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছিল, ক্ষমতায় ছিল চেপে বসা সরকার। আঙুল তুলতে পারেনি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি গেল না ২০০৮ সালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে এই ভয়ে। আঙুল তুলল আওয়ামী লীগের দিকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে নাকি তাদের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না! ২০১৮ সালে দলের নিবন্ধন বাঁচাতে নেতা হায়ার করে নির্বাচনে গেল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়েও খারাপ ফল হলো।</p> </article> <p style="text-align: justify;">কারণ তত দিনে বিএনপি একটি জনবিচ্ছিন্ন দল। এবার তাদের নিবন্ধন বাঁচানোর তাগিদ ছিল না। তাই চলতি বছর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসেনি বিএনপি ও তার সমমনারা। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। গণক না হয়েও ভবিষ্যদ্বাণী করে দেওয়া যায় যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসছে।</p> <article> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি বিধ্বংসী প্রবণতা হচ্ছে, এখানে কথায় কথায় বিদেশিদের ডেকে আনা হয়। বিদেশিদের কাছে নালিশ করা হয়। রাজনীতি বাংলাদেশের। ভোট দেবে বাংলাদেশের জনগণ। বিএনপি জনগণের কাছে না গিয়ে যায় বিদেশিদের কাছে। কিছুদিন আগেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। কী হলো সেখানে? ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে দুজনের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সহনশীলতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ঢাকা দূতাবাস প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানের সঙ্গে দেখা হয়ে তারা আনন্দিত। মঈন খান এই বৈঠক নিয়ে গণমাধ্যমকে জানান, পিটার হাসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। বৈঠকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক দৈন্য এতই প্রকট যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে তাদের মার্কিন দূতাবাসে যেতে হয়।</p> <p style="text-align: justify;">ওদিকে সরকার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির সমমনাদের একজন। তাঁর অভিযোগ, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘প্রতিষ্ঠিত’ গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘দখলে’ও ক্ষমতাসীনরা পাঁয়তারা করছে।</p> <p style="text-align: justify;">আজকাল রাজনীতিতে এই প্রবণতাটাও লক্ষ করা যাচ্ছে, যেকোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। দেশেই শুধু নয়, দেশের বাইরেও তাঁর নামটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়মিত একটি ব্রিফিং হয়। সেই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকেন একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক। তাঁর কাজ হলো মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে এমন কিছু প্রশ্ন করা, যে প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের বিপক্ষে যায়। যেমন—গত মঙ্গলবার তিনি প্রশ্ন করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলা ও বিচারকাজ নিয়ে। তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবর নিয়ে প্রশ্ন করেন, যে খবরে বলা হয়েছে, ২০ জনের একটি দল নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের দপ্তরের দখল নিয়েছে। ওই সাংবাদিক মনে করেন, বাংলাদেশে সংসদ একপক্ষীয়। বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, দুর্নীতি দমন কমিশন—সব কিছুর কার্যক্রম বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর এখন গ্রামীণ ব্যাংকের মতো আরো কিছু প্রতিষ্ঠানও দখল হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তার মতামত জানতে চান।</p> <p style="text-align: justify;">তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র যেসব কথা বলেন, তা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানেন না। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে শ্রম আইনে করা মামলাটি অস্বাভাবিক গতিতে বিচার করা হয়েছে, যা তাঁদের নজরে এসেছে। অন্য একটি মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগপত্র দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের মনে হয়েছে, শ্রম ও দুর্নীতি দমন আইনের অপব্যবহার বাংলাদেশে আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেও তাঁদের উদ্বেগ রয়েছে। তবে আপিল প্রক্রিয়া চলমান আছে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ম্যাথু মিলার এটিও জানাতে ভোলেননি যে ড. ইউনূসের মামলার ক্ষেত্রে একটি ন্যায্য ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করছে। আবার এটিও তিনি মনে করছেন যে ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভয় দেখানোর জন্য বাংলাদেশে এসব মামলায় শ্রম আইনের অপব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশি সাংবাদিকের তৈরি উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নের জবাবে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত।</p> <p style="text-align: justify;">গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে ফরেন প্রেস সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার বলেছেন, বাংলাদেশকে আরো গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে সক্ষম করতে যুক্তরাষ্ট্র এ দেশের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র অবিশ্বাস্য মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক সংগঠন এবং দীর্ঘ মেয়াদে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের নেতাদের সঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান, গণতন্ত্রের ভারসাম্য গড়ে তোলার দিকে যুক্তরাষ্ট্র মনোযোগ দিচ্ছে। মুক্ত গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, শ্রমিক সংগঠনের মতো গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভাবে কাজ করছে। এটি বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে আরো গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে সক্ষম করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি গণতন্ত্র বিপন্ন? না তো। জানতে তো ইচ্ছা করে, কারা নাগরিক সমাজের নেতা? তাঁদের সঙ্গে কি কৃষক-শ্রমিক তথা গণমানুষের কোনো সম্পর্ক আছে, নাকি তাঁরা ‘ড্রয়িং রুম বেজড সানডে ক্লাবের হোয়াইট কলার’ বিপ্লবী?   </p> <p style="text-align: justify;">কেউ যদি প্রশ্ন করেন, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান কি গড়ে উঠেছে? সেখানেও তো অভিযোগ উঠেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার সময় ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল পাল্টে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিলেন। নির্বাচনে হারের পরও তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন। সেখানকার গণমাধ্যম কি মুক্ত? তারা কি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে স্বাধীনভাবে লিখতে পারে?</p> <p style="text-align: justify;">আফরিন আখতার বলেছেন, বাংলাদেশের সমাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র অবিশ্বাস্য মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে। এর ফলটি কী দাঁড়াচ্ছে? লক্ষ করুন, গণতন্ত্র, সুশাসন ইত্যাদি নিশ্চিত করার দোহাই দিয়ে এখানে কিছু তাঁবেদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠান জরিপের নামে দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু ধারণা তৈরি করে। এসব জরিপে তাদের ‘টার্গেট পিপল’ কারা? যাদের কাছে গেলে নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যাবে, তারা। বিক্রয়যোগ্য এসব জরিপ নিয়ে উচ্চমূল্যের বাণিজ্য হয়। এই নোংরা দেশবিরোধী বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্তরাই জন পার্কিনস কথিত ইকোনমিক হিটম্যানের সহযোগী। ইকোনমিক হিটম্যানদের তৈরি প্রতিষ্ঠানের কাজই হচ্ছে প্রতারণার মাধ্যমে জনমত তাদের পক্ষে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা। দেশহিতৈষী ভদ্রলোকের মুখোশের আড়ালে দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় ইকোনমিক হিটম্যানদের সহযোগীদের নাগরিক সমাজের নেতা হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান, গণতন্ত্রের ভারসাম্য গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেনেওয়ালা বিদেশিরা দীর্ঘ মেয়াদে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অজুহাতে বাংলাদেশের এই তথাকথিত নাগরিক সমাজের নেতাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। কারণ এই সমাজটি নেতিবাচক কাজের বিনিময়ে ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ নীতিতে বিশ্বাসী। আর বিনিময়টি অনেক বড় অঙ্কের বলে এই সুধীরা ‘যেমনি নাচাও তেমনি’ নাচতে অভ্যস্ত।</p> <p style="text-align: justify;">আব্দুল মঈন খানরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যান। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কিংবা ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নিজেদের শাসনকাল নিয়ে কোনো আত্মসমালোচনা করেন না।</p> <p style="text-align: justify;">‘কাজের বিনিময়ে ক্ষমতা’ পেতে আগ্রহী সমসাময়িক কিছু রাজনৈতিক নেতা ও ‘জরিপের বিনিময়ে টাকা (ডলার)’ পেতে অভ্যস্ত নাগরিক সমাজের একাংশকে দেখা যায় দেশ ও জাতির জন্য মুখে মুখে জীবনপাত করতে। বিদেশিদের অতি আগ্রহে নিয়োজিত বর্তমান সময়ের ইকোনমিক হিটম্যানদের গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না কতটা আসল? ক্ষমতা ও অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা না পেলে ভবিষ্যতে তাঁরা কাঁদবেন তো?</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>সাংবাদিক </p> <p style="text-align: justify;">habib.alihabib@gmail.com</p> </article>