<article> <p style="text-align: justify;">কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি দৈনিকে গত ৩০ জানুয়ারি এবং ৩ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ায় আটক অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ৩০ জানুয়ারির প্রতিবেদন মতে, জানুয়ারি মাসের প্রথম ২৮ দিনে মালয়েশিয়ার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ৮৭০টি অভিযান চালিয়ে বৈধ কাগজপত্র না থাকায় চার হাজার ২৬ জন অভিবাসী কর্মীকে আটক করে। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের আটক অভিযানে সচরাচর ওই সব কর্মীর নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কিন্তু এবার ৪২ জন নিয়োগকর্তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ৩ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনটিতে মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গর রাজ্যে অবস্থান করা ৫৩০ জন অবৈধ অভিবাসী কর্মীকে আটক করার কথা বলা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৯৪ জন বাংলাদেশি রয়েছেন।</p> <p style="text-align: justify;">নানা কারণেই মালয়েশিয়া অভিবাসী কর্মীদের, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। সাধারণত পর্যটন ভিসায় তাঁরা মালয়েশিয়ায় ঢোকেন এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও থেকে যান।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ ক্ষেত্রে ওখানে কর্মরত নিজ নিজ দেশের অভিবাসীরাও সহায়ক হিসেবে কাজ করেন। দেশটিতে কর্মী চাহিদা থাকায় এবং অবৈধ কর্মীদের কম পারিশ্রমিকসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বাধ্যবাধকতা না থাকায় স্থানীয় নিয়োগকর্তারা এই সুযোগটি নিয়ে থাকেন। মালয়েশিয়া সরকার এই বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল আছে বলেই ‘রুটিন ওয়ার্ক’ হিসেবে প্রায়ই এসব অভিযান পরিচালনা করে থাকে। আটকদের জেল বা জরিমানা করা ছাড়াও তাঁদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা খুব বেশি হলে এবং স্থানীয় চাহিদা প্রকট হলে মাঝেমধ্যে ‘বৈধকরণ’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। </p> <p style="text-align: justify;">অবৈধ অভিবাসী কর্মীরা সাধারণত তিনটি উৎস থেকে এসে থাকেন—ক. পর্যটন বা অন্য উপলক্ষে কয়েক দিনের ভিসায় মালয়েশিয়ায় এসে দেশে ফিরে না যাওয়া বিদেশি নাগরিক; খ. বেশি পারিশ্রমিকের লোভে কর্মরত স্থান থেকে পালিয়ে অন্য স্থানে কাজ করা এবং গ. নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তিসময় শেষ হওয়ার পরও দেশে ফিরে না গিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় থেকে যাওয়া। তবে কর্মী হিসেবে যাঁরা ভিসা নিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে অবৈধ হয়ে যাওয়া কর্মীর সংখ্যার চেয়ে পর্যটন বা স্বল্পমেয়াদি অন্য ভিসায় আসা অবৈধভাবে অবস্থানকারী অভিবাসীদের সংখ্যাই বেশি। সাধারণত বিদেশে অবস্থিত মালয়েশিয়ার দূতাবাস থেকে দালালের মাধ্যমে পর্যটন ভিসা সংগ্রহ করে তাঁরা মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে থাকেন। বাংলাদেশ থেকেও একই প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ পর্যটকের ছদ্মবেশে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া কর্মীরা তাঁদের নির্ধারিত দালালদের মাধ্যমে ঢাকায় মালয়েশিয়ান হাইকমিশন থেকে মালয়েশিয়ার পর্যটন ভিসা সংগ্রহ করেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অনেক সময় দালালরা নিজেরাই কয়েকজনকে সঙ্গে করে মালয়েশিয়ায় নিয়ে আসেন এবং রেখে যান। মাঝেমধ্যে ঢাকা থেকে সাংস্কৃতিক, মেলায় অংশগ্রহণকারী কিংবা এনজিও প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় এসে থেকে যাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। এসবই হয়ে থাকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে নানা ছদ্মবেশে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো মানবপাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। সুষ্ঠু ও নিরাপদ অভিবাসন পদ্ধতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন না করা গেলে একজন কর্মীকে অভিবাসন বাবদ যে অর্থ ব্যয় করতে হয়, তার চেয়ে অবৈধ বা পাচার পথে বিদেশে পাড়ি জমানোর ব্যয় সাধারণত কম হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটে থাকে। বৈধ পথে অভিবাসন ব্যয় কম হলে মানবপাচারের ব্যাপকতা অনেকটাই কমে আসত। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা যদি সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশিদের কাজ না দিতেন, তাহলেও এ ধরনের কর্মীরা সেখানে যেতে এতটা আগ্রহী হতেন না। অবৈধ অভিবাসীদের জন্য কাজের সুযোগ থাকায় বিভিন্ন পন্থায় বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলো থেকে মানুষ মালয়েশিয়ায় প্রতিনিয়ত ছুটে যাচ্ছে। আর মানব পাচারকারীরা সেই সুযোগে নিজেদের পকেট ভারী করছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই অবৈধভাবে থাকা অভিবাসী কর্মীরা যেকোনো সময় ধরা পড়ে নিজের দেশে ফেরত আসতে পারেন, সেই আশঙ্কা কিন্তু সব সময়ই তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়। মালয়েশিয়ায় যেতে ধারদেনা করে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার জের টানতে হয় ওই পরিবারগুলোকেই। অনেক সময় তাঁদের জীবনও হুমকির মুখে পড়ে।  </p> <p style="text-align: justify;"><img alt="মালয়েশিয়ায় আটক অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী" height="421" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/February/06-02-2024/Untitled-1.jpg" width="500" />মানবপাচার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মানবপাচারের শিকার হয়েছিল। কক্সবাজার থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করে প্রতিবছর সংগ্রহ করা হতো প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এমনকি জিম্মি করে মোবাইল ফোনে একেকজনের পরিবার থেকে গড়ে দু-তিন লাখ টাকা আদায় করার ঘটনাও ছিল। অনেক সময় পাচারকারীরা অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে ওই ব্যক্তিকে সমুদ্রে ফেলে দিত। ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে প্রায় ৭৫০ জনকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ডের জঙ্গলের বিভিন্ন ক্যাম্পে হাজার হাজার লোক রাখা হতো এবং অস্ত্রধারী লোকজন ওই সব ক্যাম্প পাহারা দিত। পাচার হওয়া অনেক বাংলাদেশিরই ঠাঁই হয়েছিল থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কয়েকটি গণকবরে।</p> <p style="text-align: justify;">এই অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের কারণে বৈধ প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় আমাদের কর্মী প্রেরণে বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাঁদের জন্য বৈধ পথে যেসংখ্যক কর্মী প্রেরণ করা যেত, তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের আয় কম হওয়ায় মালয়েশিয়া থেকে প্রাপ্ত আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণও কমে যায়। তা ছাড়া বৈধ কাগজপত্রহীন অভিবাসী কর্মীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে অর্থ পাঠাতে পারেন না বিধায় হুন্ডির আশ্রয় নেন। ফলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই।  </p> <p style="text-align: justify;">বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে আমরা যে বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে পারি তা হলো : ১. কাজের উদ্দেশ্যে পর্যটন ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে থেকে যাওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের জনগণকে সচেতন করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা যাতে সরকার নির্ধারিত ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো প্রলোভনের শিকার না হন সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। ২. সুষ্ঠু ও নিরাপদ অভিবাসন পদ্ধতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে অভিবাসন ব্যয় সর্বনিম্ন পর‌্যায়ে নামিয়ে আনা। বৈধ পথে অভিবাসন ব্যয় কম হলে এভাবে মানবপাচারের গতি কমে আসবে। ৩. দরিদ্র, সামাজিক নিরাপত্তাহীন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয়ভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি অর্থাৎ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। ৪. কোনো প্রতিষ্ঠান বা দালাল দেশের কোনো নাগরিককেই যেন কর্ম ভিসা ছাড়া মালয়েশিয়ায় পাঠানোর প্রলোভনে ফেলতে না পারেন সেদিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ধরনের কাজে সম্পৃক্ততা পাওয়া মাত্রই প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। ৫. সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের, বিশেষ করে বিমানবন্দরে নিয়োজিতদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ৬. আমাদের দূতাবাস আটক বাংলাদেশিদের প্রয়োজনীয় আইনি সাপোর্ট দেবে। প্রয়োজনে তাঁদের উদ্ধার করে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করবে। এ ছাড়া তাঁদের এ অবস্থার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাবে। ৭. পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৮. মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত কোনো বেসরকারি কর্মকাণ্ডে (সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাণিজ্য মেলা বা এনজিও প্রগ্রাম) অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি দলে এ ধরনের উদ্দেশ্যে কেউ যাতে অন্তর্ভুক্ত না হতে পারেন সেদিকে দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।  </p> <p style="text-align: justify;">শুধু দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করাই নয়, মালয়েশিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন কর্মী প্রেরণ অব্যাহত রাখতে হলে বিভিন্ন পন্থায় মালয়েশিয়ায় গমনকারীদের অবৈধভাবে থেকে যাওয়া রোধ করতে হবে। তাঁদের থেকে যাওয়া রোধ না করতে পারলে সে দেশের কর্তৃপক্ষের এ ধরনের অভিযানের শিকার হতেই হবে এবং তাতে অবৈধ অভিবাসীদের জেল-জরিমানা ছাড়াও দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকিতে থাকতে হবে।   </p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব</p> </article>